গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও ইসরায়েলের আগ্রাসন থামেনি। পশ্চিম তীর, সিরিয়া ও লেবাননজুড়ে দেশটির অব্যাহত সামরিক অভিযান মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে অস্থিতিশীলতা তৈরি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নীরব সমর্থন ও নিষ্ক্রিয় অবস্থান এই উত্তেজনাকে আরও উসকে দিচ্ছে বলে জানিয়েছে আল জাজিরা।
আল জাজিরার সোমবারের (২৭ অক্টোবর) প্রতিবেদনে বলা হয়, ১০ অক্টোবর ঘোষিত যুদ্ধবিরতি গাজার ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি চাপ সাময়িকভাবে কমালেও, দেশটির হামলা এখনও বন্ধ হয়নি। গাজায় বোমা হামলার পাশাপাশি লেবানন, সিরিয়া ও পশ্চিম তীরেও ইসরায়েল নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, প্রতিবেশী অঞ্চলগুলোকে দুর্বল ও অস্থিতিশীল রাখাই ইসরায়েলের দীর্ঘমেয়াদি কৌশল।
পশ্চিম তীর: দমন অভিযান ও সংযুক্তির প্রস্তুতি
ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোটরিচ সম্প্রতি তার সমর্থকদের আহ্বান জানিয়েছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেন পশ্চিম তীরকে ইসরায়েলের সঙ্গে সংযুক্ত করার পরিকল্পনাকে সমর্থন করেন। তার ভাষায়, ‘পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করতে হবে, তাতেই ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের বিপজ্জনক ধারণা ঠেকানো যাবে।’
সিরিয়া: সীমান্ত লঙ্ঘন ও বোমা হামলা
সিরিয়ার দক্ষিণ সীমান্তেও ইসরায়েলি হামলার হার বেড়েছে। স্থানীয় গণমাধ্যমের তথ্যমতে, প্রায় প্রতিদিনই ইসরায়েলি বাহিনী সীমান্ত অতিক্রম করছে। গত রবিবার সকালে দক্ষিণ সিরিয়ার কুনেইত্রা প্রদেশের আল-রাজানিয়া ও সাইদা আল-হানুত গ্রামে প্রবেশ করে ইসরায়েলি বাহিনী সাময়িক চেকপোস্ট স্থাপন করে। তারা এক রুটি সরবরাহকারীকে আটক করে পরে ছেড়ে দেয়।
জাতিসংঘে সিরিয়ার প্রতিনিধি ইব্রাহিম ওলাবি ২৪ অক্টোবর নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে বলেন, ইসরায়েলকে সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে এবং গোলান মালভূমিসহ সব দখলকৃত অঞ্চল থেকে সরে যেতে হবে।
লেবানন: যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ ও উত্তেজনা
লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলেও নিয়মিত বিমান ও ড্রোন হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। সোমবার জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনী (ইউএনআইএফআইএল) জানায়, তাদের টহল দলের ওপর গ্রেনেড নিক্ষেপের ঘটনায় তারা একটি ইসরায়েলি ড্রোন গুলি করে নামিয়েছে। পরে ইসরায়েলি ট্যাংকও শান্তিরক্ষীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। যদিও কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
গত রোববার বালবাকের নবি চিত ও দক্ষিণ লেবাননের নাকুরা এলাকায় দুই ব্যক্তি নিহত হন। ২০২৪ সালের নভেম্বরের যুদ্ধবিরতি চুক্তি সত্ত্বেও ইসরায়েল এখনো লেবাননের অভ্যন্তরে অবস্থান করছে এবং প্রায় প্রতিদিনই হামলা চালাচ্ছে। এসব হামলায় বেসামরিক হতাহত ছাড়াও পুনর্গঠন প্রকল্পের যন্ত্রপাতি ধ্বংস হয়েছে।
ইসরায়েল দাবি করছে, হিজবুল্লাহর পুনর্গঠন ঠেকাতেই এসব অভিযান চলছে। কিন্তু লেবানন সরকার বলছে, এই হামলা যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন এবং সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত। তারা যুক্তরাষ্ট্রকে আহ্বান জানিয়েছে, ইসরায়েলকে এই কর্মকাণ্ডের জন্য জবাবদিহির আওতায় আনতে।
তবে মার্কিন বিশেষ দূত টম ব্যারাক এখনো ইসরায়েলকে থামাতে ব্যর্থ হয়েছেন। এতে লেবাননসহ পুরো অঞ্চলে নতুন করে শঙ্কা ও অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছে।
গাজা: যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ ও মানবিক সংকট
মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স সম্প্রতি ইসরায়েল সফরে বলেন, ‘১০ অক্টোবরের যুদ্ধবিরতি প্রত্যাশার চেয়েও ভালোভাবে চলছে।’ কিন্তু বাস্তবে গাজায় এখনও হামলা অব্যাহত রয়েছে। শনিবার রাতে নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি ড্রোন হামলায় একজন নিহত ও চারজন আহত হন বলে জানিয়েছে আল-আউদা হাসপাতাল।
যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পরও প্রায় ১০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। ইসরায়েল রাফাহ সীমান্ত দিয়ে অসুস্থদের দেশত্যাগেও বাধা দিচ্ছে—এমনকি তৃতীয় ধাপের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীকেও বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না।
ফলে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও গাজা, লেবানন ও সিরিয়া—সব জায়গাতেই ইসরায়েলের সামরিক আগ্রাসন নতুন করে সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি করছে। মধ্যপ্রাচ্য যেন আবারও জ্বলতে শুরু করেছে আগের মতোই, শুধু আকারে এখন তা আরও বিস্তৃত।

ডিজিটাল ডেস্ক 






















