ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে ভিন্ন কৌশলে এগোচ্ছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। সরকার, বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি ও তরুণদের দল এনসিপি-কারোর সঙ্গেই দূরত্ব চায় না দলটি। এজন্য নির্বাচনের সময়সীমা ইস্যুতে বারবার অবস্থান পরিবর্তন কৌশলেরই অংশ। বিএনপির সঙ্গে থাকার বিষয়ে জামায়াতের ওপর তৃণমূলের একটি বড় অংশের চাপ রয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা না করা হলেও নির্বাচনি মাঠ গোছাচ্ছে জামায়াত। দুই শতাধিক আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীও ঘোষণা করেছে। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে দলীয় অবস্থানকে অনেকে ‘অস্পষ্ট’ বলছেন। পাশাপাশি এটিএম আজহারুল ইসলামের মুক্তির বিষয়েও দলীয় অবস্থান নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। তাদের অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ নিয়ে সমালোচনা করছেন।
গত ১৬ এপ্রিল মার্কিন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকের পর জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছিলেন, প্রথম রমজানের আগেই তারা জাতীয় সংসদ নির্বাচন চান। ঠিক এর পরদিন এক সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতের আমির বলেন, প্রয়োজনীয় সংস্কার, দৃশ্যমান বিচারসহ তিন দাবি পূরণ হলে নির্বাচন হতে পারে। ১৯ এপ্রিল লালমনিরহাটে এক জনসভায় জামায়াতের আমির বলেন, নির্বাচনে আগে অবশ্যই সরকারকে দুটি কাজ নিশ্চিত করতে হবে-খুনিদের বিচার দৃশ্যমান ও প্রয়োজনীয় সংস্কার। সর্বশেষ শুক্রবার (গতকাল) ময়মনসিংহে এক কর্মী সম্মেলনে তিনি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ কামাল বলেন, জামায়াত একটি রাজনৈতিক দল। তারা দেখবে তাদের জন্য যেটা সুবিধা, তারা সেই দাবিটাই করবে। রাজনীতি মানেই হলো দরকষাকষি। দরকষাকষির ক্ষেত্রে যারা যা সুবিধা মনে করবে, তারা ওটাই করবে। আগামীকাল যদি কেউ জামায়াতকে গ্যারান্টি দেয় এই নির্বাচনে এখন অংশ নিলে জিতবেন, তাহলে আগামীকালই অংশ নেবে। নিজেদের দলের রাজনৈতিক বিজয়ের জন্য যা যা করা দরকার, তারা তাই করবে। এটাই রাজনীতি।
যদিও নির্বাচন ও সময়সীমা নিয়ে সম্প্রতি একটি ইউটিউব চ্যানেলে সাক্ষাৎকারে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান দলীয় অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। সেখানে তিনি বলেন, যারা গণহত্যা করেছে, সেই খুনিদের দৃশ্যমান বিচার একটি দাবি। আরেকটা হচ্ছে প্রয়োজনীয় সংস্কার, সব সংস্কার নয়। দৃশ্যমান বিচার বলতে আমরা দেখতে চাই, যারা প্রধান প্রধান অপরাধী, যারা হুকুমদাতা, তাদেরকে বিচারের প্রক্রিয়ায় আনা হয়েছে, ট্রায়াল শুরু হয়েছে এবং ট্রায়াল তার স্বাভাবিক গতিতে চলছে। যদি এর মধ্যে রায় হয়, ভালো। যদি রায় না হয়, মানুষ বিশ্বাস করবে বিচার হবে। এবং বিচার একবার শুরু হলে তা আর কেউ থামাতে পারবে না। এ মামলা গুরুত্বপূর্ণ অপরাধের মামলা। এ মামলায় যেনতেনভাবে বিচার হোক, এটাও আমরা চাই না। আমরা চাই বিচারটা নিখুঁতভাবে হোক, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হোক। বিচারের দাবি সবার, সেই বিচার দৃশ্যমান হতে হবে।
তিনি বলেন, সংস্কারের জন্য কতটুকু সময় লাগবে, নির্বাচন কখন হবে-এটা নিয়ে কথা। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ হচ্ছে ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে। এটা আমরা মনে করি, বুঝেশুনেই বলেছেন তিনি। এতে তার (প্রধান উপদেষ্টা) আন্তরিকতাও আছে বলে আমি মনে করি। এখন শুধু দেখতে চাই, তার দেওয়া সময়সীমার ভেতরে তিনি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের যাবতীয় পদক্ষেপ নেবেন। এর জন্য অনেকের অনেক শর্ত থাকতে পারে। আমাদের শর্ত হচ্ছে পাঁচটি খাতে কিছু সংস্কার লাগবে। এগুলো হচ্ছে-নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা, সিভিল প্রশাসন এবং দুর্নীতি দমন কমিশন। এই প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো করে যদি নির্বাচনে যাওয়া যায়, তাহলে নির্বাচনটা অর্থবহ হবে এবং জনগণের মতের প্রতিফলন ঘটবে। এছাড়াও কিছু সংস্কার আছে, সেগুলো পর্যায়ক্রমে হবে। একটা নির্বাচিত সরকার এসে তারা এ দায়িত্ব পালন করবে।
জামায়াত আমির বলেন, সংস্কার ও বিচারের দৃশ্যমান প্রক্রিয়া যদি জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় এবং নির্বাচনের সমতল মাঠ তৈরির জন্য হয়, তাহলে নির্বাচন ডিসেম্বরে হতে পারে, জুনেও হতে পারে। আমরা কেন ফেব্রুয়ারির আগে বললাম, কেন রমজানের আগে বললাম? কারণ, রমজান মাস থাকবে ফেব্রুয়ারির ১৮ থেকে শুরু করে ২০ মার্চ। এরপর এপ্রিলে সাধারণত ঝড় শুরু হয়ে যায়, প্রাকৃতিক আবহাওয়া খারাপের দিকে যায়। তারপর কুরবানির ঈদ। আবার দুটি পাবলিক পরীক্ষা (এসএসসি ও এইচএসসি) এর মধ্যে পড়বে। এরপর বর্ষার মৌসুম। এসবের কারণে নির্বাচনটা মধ্য ফেব্রুয়ারির আগে হলে অনেক ভালো হয়।
জানতে চাইলে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচনের ব্যাপারে জামায়াতের আমির ব্যাখ্যা দিয়েছেন-প্রধান উপদেষ্টা টেন্টিটিভ আউট লাইনটা (ডিসেম্বর থেকে জুন) দিয়েছেন, সেখানে উনি (জামায়াত আমির) বলেছেন, মে-জুনে বর্ষাকাল, এর আগে এসে যাবে রমজান। এসব সময়ে সাধারণত নির্বাচনি রেওয়াজ আমাদের দেশে নেই বলে নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। ফলে জুনে ঘোষিত যে সময়, এটার ওপরে উনি (প্রধান উপদেষ্টা) যেন ঠিক থাকেন, এটা আমরা দেখতে চাই। এবং এই সময়ের মধ্যে কী কী আশঙ্কা থাকতে পারে, এটা মনে করিয়ে দিয়েছেন। এটা বুঝে তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) যে কোনো সময় নির্বাচন করবেন। এজন্য একটা ক্রেডিবল ফ্রি ইলেকশনের জন্য নির্বাচনি প্রক্রিয়া সংস্কার করতে হবে। তারপর মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার করতে হবে।
এদিকে এটিএম আজহারের মুক্তি নিয়ে দলীয় অবস্থানে ক্ষোভ বাড়ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে জামায়াতের পাশাপাশি ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতারাও সমালোচনা করে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। জামায়াতের সমালোচনা করে দলটির সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামীর ছেলে মোহাম্মদ নাদিমুর রহমান বৃহস্পতিবার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে লেখেন, ‘কথাগুলো শতভাগ সত্য এবং যৌক্তিক। আর জামায়াতের নীতি-আদর্শ থাকবেই বা কী করে? জামায়াতের যেই ছয় নেতার অন্যায়ভাবে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছে, তাদের এই ফাঁসি ঠেকাতে পারলেই না জামায়াতের নীতি-আদর্শ ঠিক থাকত।
উলটো ছোট জন বলেছিলেন, ‘তারা এখন জেলখানায় আরাম করুক আর আমরা এখন একটু খাই।’ আর বড়টা তো পরে মুখ ফসকে বলেই ফেলেছিলেন, ‘তারা জেলখানায় পচে মরুক, আমরা আমাদের সংগঠন গোছাব, না হলে আমাদের সন্ত্রাসী সংগঠন বানিয়ে দেবে। পরবর্তী সময়ে তো আবার আরেকটা সলিমুদ্দীন না কলিমুদ্দীন কী নাম, এক বক্তৃতায় তো বললেনই, ‘আমরা যদি আইন না মানতাম তাহলে আপনারা আমাদের একটা নেতাকেও ফাঁসি দিতে পারতেন না।’ আরে ছাত্ররাও যদি আইন মানত, তাহলে এই জালেম হাসিনা সরকারের পতন জীবনেও ঘটাইতে পারত না।’
নিজামীপুত্র আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ নতুনভাবে স্বাধীন হওয়ার পর আওয়ামী লীগকে ক্ষমা করার কথা বলে কে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন চায় এটা পুরো ক্রিস্টাল ক্লিয়ার। এখন আবার শুরু করেছে সকালে এক কথা আর রাতে আরেক কথা বলা। আবার অন্যদিকে এক নেতার এক কথা আবার আরেক নেতার আরেক কথা। অর্থাৎ কোনোটার সঙ্গে কোনোটার মিল নেই। আর তাই তো দোয়া করি এটিএম আজহারুল ইসলাম সাহেব দ্রুত মুক্তি পেয়ে শহিদের এই রক্তভেজা সংগঠনটির (জামায়াত) হাল ধরুক।’