এরই মধ্যে আগামী ২৮ জুন সম্মেলন স্থগিতের খবরে সেই দ্বন্দ্ব রূপ নিয়েছে প্রকাশ্যে। আসন্ন সম্মেলনকে কেন্দ্র করে চাপ বাড়ছে জাতীয় পার্টির অভ্যন্তরে। সম্মেলনের দিনক্ষণ যতই ঘনিয়ে আসছে দুরুত্ব বাড়ছে দলের সিনিয়র নেতাদের মধ্যে। এ অবস্থায় পরস্পর বিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন দলীয় সিনিয়র নেতারা।
জাপার নেতাকর্মীরা বলছেন, ৫ আগস্টের পর দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে সরাতেই একাট্টা হয়েছেন দলের বর্তমান এবং সাবেক জ্যেষ্ঠ নেতারা। এ কারণেই সৃষ্টি হয়েছে এই পরিস্থিতি।
এই খবরটি জানাজানি হতেই সম্মেলন ঘিরে জাপা নেতাদের চরম বিরোধের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে।
দলটি হাইকমান্ডে ভাঙনের ধাক্কা ছড়িয়েছে তৃণমূলেও।
দলটির নেতাকর্মীদের অনেকই মনে করেন, আওয়ামী লীগের আমলে ‘গৃহপালিত বিরোধী দলের’ ভূমিকার কারণে দলটি ইমেজ সংকটে পড়েছে। শেখ হাসিনার শাসনামলের বিরোধীদলীয় নেতা জি এম কাদেরকে নেতৃত্ব থেকে সরানো ছাড়া জাপাকে সরকার এবং ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর চাপ থেকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। তাই নতুন সম্মেলনে দলটির নেতৃত্বে পরিবর্তন আসতে পারে। এই আশঙ্কাকে সামনে রেখেই ২৮ জুন সম্মেলন স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে।
আনিসুল ইসলাম মাহমুদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা পার্টির প্রেসিডিয়ামের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২৮ জুন কাউন্সিল করব। আমি চেয়ারম্যান পদে ও রুহুল আমিন হাওলাদার মহাসচিব পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব। কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে আমরা দলের নেতৃত্বের পরিবর্তন চাই।’
এ দিকে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদার এক যৌথ বিবৃতিতে দলীয় চেয়ারম্যানের সম্মেলন স্থগিতের সিদ্ধান্তকে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক ও অনভিপ্রেত বলে মন্তব্য করেন। বিবৃতিতে তারা আশা প্রকাশ করেন, দলীয় গঠনতন্ত্র ও প্রেসিডিয়াম সভার সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান জানিয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ২৮ জুন দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সম্মেলন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করবেন।
তবে দলটির জি এম কাদেরপন্থী নেতারা মনে করছেন, সম্মেলন নয়। মূলত আসন্ন নির্বাচন ঘিরেই জি এম কাদেরকে সরাতে একজোট দলের ‘কয়েকজন নেতা’। নির্বাচনের আগ মুহূর্তে দলকে বেকায়দায় ফেলতে সরকারের চাপের মুখেই এমনটি করা হচ্ছে বলে ধারণা তাদের। ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ তকমা থেকে মুক্তি পাওয়ার বিষয়টিও এখানে মুখ্য নয়। কেননা আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদার নিজেরাই আওয়ামী শাসনকালে ২০১৪ সালের ‘রাতের নির্বাচন’ এবং ২০১৮ সালের ‘ডামি নির্বাচনে’ অংশ নিয়েছিলেন।
জি এম কাদেরের ঘনিষ্ঠ এক নেতা গণমাধ্যমকে বলেন, বিএনপি সর্বশেষ সম্মেলন করে ২০১৬ সালে। কিন্তু দলটিকে সম্মেলন করতে বলছে না কমিশন। অথচ জাপাকে সম্মেলনের জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। এ কারণে ধারণা করা হচ্ছে, জি এম কাদেরকে নেতৃত্ব থেকে সরাতে সরকারের ইন্ধন রয়েছে। যারা নেতৃত্বে আসতে চাইছেন, অতীতে তাদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে।
চ্যালেঞ্জের মুখে জি এম কাদের
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারকে শুরুতে সমর্থন জানিয়েছিল জাপা। বঙ্গভবন এবং যমুনায় একাধিক বৈঠকেও ডাক পায়। তবে দলটির আওয়ামী লীগ আমলের ভূমিকার কারণে অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতারা জাপাকে বৈঠকে ডাকার বিরোধিতা করে। পরে জাপার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হামলা হয়। সবশেষ হামলা হয়েছে জি এম কাদেরের রংপুরের বাসভবনে। জি এম কাদের অভ্যুত্থানের সময়ে শিক্ষার্থীদের পক্ষে সরব হয়ে শেখ হাসিনার সমালোচনা করলেও জুলাইয়ের একাধিক হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে তাকে।
জি এম কাদেরকে জাপার চেয়ারম্যান করার বিপক্ষে ছিলেন এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদ। গত বছরের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে জি এম কাদেরের নেতৃত্বে অংশ নেয় জাপা। দল থেকে বাদ পড়েন রওশন এবং তার অনুসারীরা। এর দুই মাস পর রওশনকে চেয়ারম্যান করে জাপা নামে পৃথক দল গঠন করা হয়। এতে জাপার কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশিদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলাসহ একাধিক নেতা যোগ দেন। আগে দলের শুধুমাত্র দলের ভেতরে চাপ থাকলেও এবার অবশ্য পরিস্থিতি পুরোপুরি ভিন্ন।
দলের অভ্যন্তরীণ চাপের পাশাপাশি, রাজনৈতিক চাপও সামলাচ্ছেন জিএম কাদের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জি এম কাদের গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এঁদের কারণেই জাতীয় পাটিকে আওয়ামী লীগের দোসর বা দালাল হিসেবে অপবাদ দেওয়া হয়। এর মধ্যে কেউ কেউ আছেন, যাঁদের আমরা সম্মান দিয়ে পদে রেখেছিলাম। তারা সব সময় ফাও কিছু পাওয়ার অপেক্ষায় থাকেন। আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে হয়তো কেউ এঁদের কিছু প্রলোভন দিয়েছে। কিন্তু তারা কোথাও দাঁড়াতে পারবে না। আমি মনে করি, আবর্জনার ওই গ্রুপটা চলে গেলে দলটা বরং একটা লাইনে থাকবে।’