রোববার (১১ মে) জনপ্রিয় গণমাধ্যম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ‘ইনসাইড আউট’ নামের এক আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। এর মধ্যে গত ১৯ এপ্রিল নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। ওই প্রতিবেদনে ৪৩৩টি সুপারিশ রয়েছে। এরপর থেকেই এ কমিশন এবং এর সুপারিশ নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক ও সমালোচনা।
- নারী সংস্কার কমিশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের প্রকাশ্যে বিচারের দাবি মুফতি ফয়জুল করীমের
- নারী সংস্কার প্রস্তাবনা পরিবার ব্যবস্থাপনা ভাঙার গভীর নীলনকশা: আহমাদুল্লাহ
- নারী সংস্কার কমিশনের অনেক প্রস্তাব স্ববিরোধী: জামায়াত আমির
- নারী সংস্কার কমিশনের যেসব সুপারিশে আপত্তি
ফরহাদ মজহার বলেন, ‘এ পর্যন্ত যতগুলো সংস্কার কমিশন হয়েছে, অধিকাংশ কমিশনের রিপোর্ট খুব বেশি ইতিবাচক নয়। কিন্তু সুপারিশগুলো নিয়ে আলোচনা করতে পারি, কোনো সমস্যা নেই। আমরা বলব—এ সমস্ত সুপারিশের মধ্যে সত্যিকারের গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিট নেই। একটা মাত্র (নারী) কমিশনের রিপোর্ট ছাড়া। আরেকটি আছে শুনেছি, সেটা হচ্ছে শ্রম কমিশন।
‘নারী কমিশন তো বিতর্কিত হবেই। কারণ এটি গণঅভ্যুত্থান ও জনগণের অভিপ্রায়কে প্রতিনিধিত্ব করে।’
নারী কমিশনের সুপারিশে সংবিধান, আইন ও নারীর অধিকার বিষয়ে সমতা ও সুরক্ষার ভিত্তি জোরালো করার কথা বলা হয়েছে। নারীর অগ্রগতির জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও জাতীয় সংস্থার দক্ষতা বৃদ্ধির কথাও রয়েছে।
তবে ইসলামী দল হেফাজতে ইসলাম এই কমিশন বাতিলের দাবি জানিয়েছে, জামায়াতে ইসলামিও প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে। মূল আপত্তি ইসলামি উত্তরাধিকার ও পারিবারিক আইন নিয়ে কমিশনের পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ ঘিরে।
ফরহাদ মজহারের মতে, একজন নাগরিক হিসেবে নারীর ব্যক্তি অধিকারের কথাই কমিশন বলেছে। তিনি বলেন, ‘সে যদি মনে করে তার সম্পত্তি বণ্টন রাষ্ট্রীয় আইনে হবে, এটা খারাপ কিছু বলেছে কি? আমি যদি মনে করি পারিবারিক আইনের মধ্যে আমি সম্পত্তি বণ্টন চাই না, আমি তো চাইতেই পারি রাষ্ট্রের কাছে। তারা কি বলেছে শরিয়াহ আইন বদলাও? কোথাও তো তা লিখেনি। কোরআনকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করতেও বলেনি।’
প্রতিবেদনে নারীর সম্পত্তিতে সমান অধিকার, অভিভাবকত্বে সমতা, নারী বিষয়ক স্থায়ী কমিশন গঠন, অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন ১৮৯০ সংশোধন, যৌনপেশাকে অপরাধ হিসেবে না দেখাসহ শ্রম আইন সংশোধনের মাধ্যমে যৌনকর্মীদের মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিতের সুপারিশ করা হয়েছে।
এই যৌনকর্মী প্রসঙ্গেও কমিশনকে অবমাননাকর ভাষায় আক্রমণ করে মন্তব্য করা হয়েছে বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক দলের পক্ষ থেকে। এমনকি হেফাজতে ইসলামের এক সমাবেশে নারী কমিশনকে ‘বেশ্যা কমিশন’ বলার মতো কটূক্তিও করা হয়, যদিও পরে তারা দুঃখ প্রকাশ করে।
ফরহাদ মজহার বলেন, ‘যৌনকর্মী ইস্যুটি অত্যন্ত গুরুতর মানবিক ও রাজনৈতিক বিষয়। ফিলোসফাররা বলেন ‘বেয়ার লাইফ’—অর্থাৎ এমন জীবন, যার কোনো আইনি সুরক্ষা নেই। যৌনকর্মীরাও সেই অবস্থায় পড়েন। রাষ্ট্র তাদের রক্ষা করে না, হামলা-নির্যাতনের কোনো সুরক্ষা নেই।’
তিনি বলেন, ‘নারী কমিশনের রিপোর্ট বাদ দেন, বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেন। কিন্তু আপনি বলুন, আপনি তাদের জন্য কী করতে চান? সে তো দেশের নাগরিক। আপনি যদি বলেন এ পেশা বন্ধ করবেন, তাহলে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করুন। আইন সংস্কারের কথা যখন উঠেছে, তখন তাদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতেই হবে।’
বর্তমানে যৌনকর্মীদের জন্য বয়সসনদ গ্রহণের যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে, সেটির প্রসঙ্গ তুলে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘রাষ্ট্র যখন সার্টিফিকেট দিচ্ছে যৌনকর্ম করার জন্য, তখন তাদের সুরক্ষা নিশ্চিতের দায়িত্বও রাষ্ট্রের। যৌনকর্মীর নাগরিক অধিকার স্বীকার না করে আপনি সমালোচনা করবেন—এটা তো দ্বিচারিতা।’
তিনি আরও বলেন, ‘যারা সমালোচনা করছেন, তাদের তো কখনো দেখি না যৌনপেশা বন্ধের দাবিতে মিছিল করতে। অথচ ইসলাম বলে, কোনো মেয়ে যদি পেটের তাগিদে এমন পেশায় আসে, প্রথম দায় ওই এলাকার ইমামের। কারণ ইসলাম সমাজকেন্দ্রিক ধর্ম।’
‘আপনি যদি সত্যিই চান এই পেশা বন্ধ হোক, তাহলে ইসলামের মানবিক দিকটি সামনে আনুন। কিন্তু এখন তো যা হচ্ছে তা ইসলামবিরোধী—আপনারা মেয়েদের গালাগাল দিচ্ছেন।’
নারী সংস্কার কমিশনের সদস্যদের বিরুদ্ধে অপমানজনক কটূক্তি, বিশেষ করে ‘হাসিনা’ নামে কটাক্ষ করাকে অন্যায় বলে মনে করেন ফরহাদ মজহার। তিনি বলেন, ‘এভাবে নারীদের অপমান করা ইসলামবিরোধী কাজ। এটা বন্ধ হওয়া দরকার। নারীদের সম্মানহানিতে আমাদের কোনো সম্মান বাড়ছে না; বরং সমাজ নিচে নেমে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আসুন, তর্ক করেন—এ নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু ঘৃণাভাষা দিয়ে নারীকে অপমান করা বন্ধ হোক।’