ময়মনসিংহ , সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম ::
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বললেন শেখ হাসিনাকে ফেরাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়া হয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত শিশু আরাফাত মারা গেছে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তদন্ত কমিশন গঠন: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ঘন কুয়াশায় নাটোরে ৬ ট্রাকে সংঘর্ষ, নিহত ১ আহত ৭ ডলার বাজারে অস্থিরতা, লেনদেনের তথ্য চায় বাংলাদেশ ব্যাংক সাবেক এমপি পোটন রিমান্ডে যুবদল নেতা হত্যা মামলায় টিউলিপ সিদ্দিককে যুক্তরাজ্যে জিজ্ঞাসাবাদ,৪ বিলিয়ন পাউন্ড আত্মসাৎ চিরকুট লিখে বীর মুক্তিযোদ্ধা আত্মহত্যা করলেন দুদকের মামলা স্ত্রী-কন্যাসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুরের বিরুদ্ধে ময়মনসিংহে সরকারি প্রতিষ্ঠানে চলছিল অস্ত্র-মাদক কেনাবেচা
নোটিশ :
প্রতিটি জেলা- উপজেলায় একজন করে ভিডিও প্রতিনিধি আবশ্যক। যোগাযোগঃ- Email- matiomanuss@gmail.com. Mobile No- 017-11684104, 013-03300539.

নারী জীবন সংগ্রামের সূচনা “ঝর্ণা ফেব্রিক্স”

  • Reporter Name
  • আপডেট সময় ০১:০৪:২৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
  • ১৯৭ বার পড়া হয়েছে

অনলাইন সংবাদ: একটা ঘরে একটি মাত্র সেলাই মেশিন আর ক্ষুদ্রঋণের পাঁচ হাজার টাকায় কেনা এক বান্ডিল কাপড় নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল “ঝর্ণা ফেব্রিক্স”। তখন কি জানতাম, এই বুটিকের দোকান আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়াবে, যা একদিন নেদারল্যান্ডসের রানিও দেখতে আসবেন?

এমন একটা সময়ে “ঝর্ণা ফেব্রিক্স” চালু করতে হয়েছিল যখন হঠাৎ করেই আমার পুরো পরিবারের ভরণপোষণ আমার কাঁধে এসে পড়েছিল।

গাজীপুরের টঙ্গিতে আমাদের বাড়ি। আমার স্বামী সামসুল দুবাইয়ে ঝালাইয়ের কাজ করতেন। চার বছর পর তিনি বাড়ি ফিরে আসেন। তখন জমানো টাকা দিয়ে দেশেই একটি ব্যবসা দাঁড় করাই আমরা। কিন্তু তার ভাই পুরো টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়ে যায়।

আমার স্বামী এই ধকল সামলাতে পারেননি। এই ঘটনায় তিনি একদমই ভেঙে পড়েন। গুরুতর হৃদরোগ ধরা পড়ে তার। ফলে সপ্তাহের পর সপ্তাহ হাসপাতালে দৌড়াতে হচ্ছিল আমাদের। কিন্তু সেখানে কোনো পরিষ্কার দিকনির্দেশনা পাচ্ছিলাম না। মনে হচ্ছিল একই বৃত্তে যেন ঘুরপাক খাচ্ছি। চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে আমাদের কাছে থাকা বাকি অর্থও শেষ হয়ে গেল। অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে পড়ল যে, বাচ্চাদের স্কুলের বেতনও দিতে পারছিলাম না।

এটা ছিল আমাদের জীবনের সবচেয়ে অন্ধকার অধ্যায়।

প্রতিবেশীদের অনুরোধে আমি মাঝে-মধ্যে জামা সেলাইয়ের কাজ করতাম। নিজে থেকেই এই কাজটা শিখেছিলাম। এ থেকে যে কয়টা টাকা পেতাম তা দিয়ে বাচ্চাদের জন্য ফল, বিস্কুট এসব কিনতে পারতাম। সেখান থেকেই শুরু।

সেই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে ব্র্যাকের গ্রাম উন্নয়ন কর্মসূচিতে যোগ দিলাম। সেখানে ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনার ওপর একটি সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হলো। প্রশিক্ষণের পরে একটি ক্ষুদ্রঋণ নিই।

এই টাকা খরচ করতে গিয়ে বিরাট দোলাচলের মধ্যে পড়ে গেলাম। কারণ, এক বছরের মধ্যেই মাসিক কিস্তিতে আমাকে টাকা ফেরত দিতে হবে। যদি সেটা দিতে না পারি?

যদি আমার ব্যবসা ঠিকঠাক না চলে—সেই ভয়ে ভবিষ্যতের কিস্তি পরিশোধ করতে তখনই ৫০০ টাকা আলাদা করে রাখলাম। বাচ্চাদেরকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে একদিন ছোট বোনকে সাথে নিয়ে ঢাকার ইসলামপুরে পাইকারি কাপড়ের বাজারে চলে গেলাম।

সেখানে সারিবদ্ধ শত শত কাপড়ের দোকান। ক্রেতা-বিক্রেতাদের অধিকাংশই পুরুষ, গোটা এলাকায় তাদের ভিড় আর ধাক্কাধাক্কি। পুরো এলাকায় ছড়িয়ে ছিল লিনেন, সুতি কাপড় আর ঘামের গন্ধ।

হাতের মুঠোয় ঋণের টাকা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেবল দেখেই যাচ্ছিলাম আমি। লোকজন কেমন করে যেন তাকাচ্ছিল। হঠাৎ গাঢ় কালোর ওপরে হালকা ধূসর রঙের ফুলের নকশা করা কাপড়ে আমার চোখ আটকে গেল। দোকানদার জানালেন, এটাকে “অরবিন্দ ভয়েল” বলা হয়। এটার মান ভালো, তুলনামূলক সস্তা এবং আরামদায়ক।

পনেরো মিনিট ধরে দামাদামি করলাম। বেশি দামে কিনে ঠকার সাধ্য আমার ছিল না। তাই আমি কেনার আগ্রহ নেই জানিয়ে চলে যাওয়ার ভান করি। কাপড়ের প্রকৃত দাম আমি জানি—আত্মবিশ্বাসের সাথে এমনটা জাহির করি। শেষ পর্যন্ত ছোটোখাটো একটা দরকষাকষির পরে আমার প্রায় ৬০০ টাকা বেঁচে গেল।

ফিরে এসে কাজে লেগে পড়লাম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা নোটবইতে আঁকিবুকি করে হিসাব করতে বসলাম কী দামে, কখন আমাকে পণ্য বিক্রি করতে হবে। অবশেষে সেলাই করতে শুরু করি। পরদিন ঝর্ণা ফেব্রিক্স যাত্রা শুরু করে। লোহার একটি রডে আমার তৈরি পোশাকগুলো ঝুলিয়ে রেখে পাশ দিয়ে যাওয়া কারও জন্য অপেক্ষা করতে থাকি।

আধা ঘণ্টারও কম সময়ে আমার প্রথম ক্রেতার দেখা পেয়ে যাই। প্রথম দিনেই তিন হাজার টাকার কাপড় বিক্রি করি। চারদিনে বিক্রি পৌঁছে যায় নয় হাজার টাকায়, যা আমার প্রাথমিক বিনিয়োগকে দ্বিগুণ করে দেয়।

বিক্রি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনায় নিজের সামর্থ্যের ওপর বিশ্বাস বাড়ছিল। তখন আমি আরও ঋণ নিয়ে কর্মী এবং সেলাই মেশিনে বিনিয়োগ করি।

ব্যবসা ক্রমশ বড় হতে থাকে। আমার তৈরি পোশাকের কাটিং, মেকিং, ডিজাইন ইত্যাদি নিয়ে এমন বড় বড় জায়গায় আলোচনা হচ্ছিল যেখানে কোনোদিনই যাইনি আমি।

২০০৫ সালে পাশের এলাকায় একটি টেক্সটাইল কারখানায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের এক সেমিনারে অংশ নেই। সেখানে নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত উপস্থিত ছিলেন। আমার কাজ তাঁর নজর কাড়ে। এরপর দূতাবাসের কর্মকর্তারা আমার কারখানায় আসতে শুরু করেন। সেসময় তাঁরা সবকিছুর ছবি তুলে নিয়ে যান।

তখন কি আর জানতাম যে, এলাকা ছাড়িয়ে আমার নাম পৌঁছে গেছে ভিনদেশের এক রানির কাছে!

রানি আসার ছয় মাস আগেই প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়।

আমার বাড়িতে আসার রাস্তা মেরামত করা হয়। বৃষ্টি হলে যাতে হাঁটতে সমস্যা না হয় সেজন্য উঁচু কাঠামো স্থাপন করা হয়। রাস্তা ঘিরে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ান পুলিশ কর্মকর্তারা। ২০১৪ সালে বড়দিনের আগে, ডিসেম্বরের শীতের একদিন রানি ম্যাক্সিমা প্রবেশ করেন ঝর্ণা ফেব্রিক্সের দরজা দিয়ে। তাঁকে আমার কাজ দেখানোর পাশাপাশি আমার সঙ্গে কাজ করা দারুণ মেধাবী মেয়েদের সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিলাম। তিনি আমাদের সাথে ৪৫ মিনিট ছিলেন, যা ছিল নির্ধারিত সময়সূচির চেয়ে কুড়ি মিনিট বেশি।

পরিদর্শনের কিছুদিনের মধ্যেই নেদারল্যান্ডস থেকে রানি বেশ কিছু আধুনিক সেলাই মেশিনের সাথে ফ্যাশন ডিজাইনার রোজম্যারিকেও পাঠান।

নারীদের প্রয়োজনকে কেন্দ্র করে আমরা পোশাক ডিজাইন করি। কঠিন কাজের সময়ও তারা যেন দিনভর আরামের পোশাক পরে থাকতে পারে, সেটাকে অগ্রাধিকার দিই আমরা। আলাদা আলাদা পোশাক সামলানো মেয়েদের জন্য যে কতটা কঠিন সেটা ক্রেতারা আমাকে প্রায়ই বলতেন। তখন আমি “একের ভেতরে তিন” একটি পোশাক নকশা করি, যা একসঙ্গে চাদর, হিজাব এবং ফেস মাস্কের কাজ করে। তাৎক্ষণিকভাবে পোশাকটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।

রানির প্রথম পরিদর্শনেই ঘটনার শেষ হয়নি। আমাদের মধ্যে যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। চার বছর পর তিনি আবার আসেন।

এখন আমার সংকট সমাধানের পথ নিজের কাছেই আছে। অন্যদের সমস্যা সমাধানেও আমি ঝর্ণা ফেব্রিক্সের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাই।

বর্তমানে এখানে ১৬জন নারী কাজ করেন। কোনো পুরুষ নেই। মেয়েরা তাদের ইচ্ছেমতো কাজ করতে পারে, বাচ্চাদের কাজে নিয়ে আসতে পারে, শিশুরা এখানে নাচতে পারে, গাইতে পারে। নিজেদেরকে এখানে ঢেকে রাখতে হয় না, কোনো গণ্ডির মাঝে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতে হয় না।

অর্থনৈতিক লেনদেনের দায়িত্বও তাদের ওপরেই থাকে, যা তাদেরকে মালিকানার অনুভূতি দেয়। তারা ক্রেতাদের থেকে টাকা সংগ্রহ করে, হিসাব রাখে; নিজেদের আয় নিজেদের কাছে রেখে বাকিটা আমাকে দেয়। বিশ্বাস এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এই ব্যবসার লাভের টাকা থেকে আমি দশজন শিক্ষার্থীর স্কুলের বেতন পরিশোধ করি। এদের দুইজন আমাদের কর্মীদের পরিবারের, বাকি আটজন প্রতিবেশী পরিবারের।

আমার স্বামী এখন আমার “ওয়ার্কিং পার্টনার”। আমার ছেলে সিঙ্গাপুরের একটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকৌশলে স্নাতক শেষ করে কাজ করছে বাংলাদেশের মেট্রোরেল প্রকল্পে।

ঝর্ণা ফেব্রিক্স আমার পরিচয়, উদ্দেশ্য, তরুণ নারীদের মেধা বিকশিত করার এক নিরাপদ জায়গা এবং আমার এলাকার শিশুদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। আমি অনেক মুনাফা চাই না। আমি একটি আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাই, নারীদের আত্মনির্ভরশীল হওয়ার পথটাকে সহজ করতে চাই। এ এক সময়সাপেক্ষ কাজ। কিন্তু তা অর্জনের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

ট্যাগস

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সঞ্চয় করে রাখুন

আপলোডকারীর তথ্য

Admin

doinikmatiomanuss.com

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বললেন শেখ হাসিনাকে ফেরাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়া হয়েছে

নারী জীবন সংগ্রামের সূচনা “ঝর্ণা ফেব্রিক্স”

আপডেট সময় ০১:০৪:২৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

অনলাইন সংবাদ: একটা ঘরে একটি মাত্র সেলাই মেশিন আর ক্ষুদ্রঋণের পাঁচ হাজার টাকায় কেনা এক বান্ডিল কাপড় নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল “ঝর্ণা ফেব্রিক্স”। তখন কি জানতাম, এই বুটিকের দোকান আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়াবে, যা একদিন নেদারল্যান্ডসের রানিও দেখতে আসবেন?

এমন একটা সময়ে “ঝর্ণা ফেব্রিক্স” চালু করতে হয়েছিল যখন হঠাৎ করেই আমার পুরো পরিবারের ভরণপোষণ আমার কাঁধে এসে পড়েছিল।

গাজীপুরের টঙ্গিতে আমাদের বাড়ি। আমার স্বামী সামসুল দুবাইয়ে ঝালাইয়ের কাজ করতেন। চার বছর পর তিনি বাড়ি ফিরে আসেন। তখন জমানো টাকা দিয়ে দেশেই একটি ব্যবসা দাঁড় করাই আমরা। কিন্তু তার ভাই পুরো টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়ে যায়।

আমার স্বামী এই ধকল সামলাতে পারেননি। এই ঘটনায় তিনি একদমই ভেঙে পড়েন। গুরুতর হৃদরোগ ধরা পড়ে তার। ফলে সপ্তাহের পর সপ্তাহ হাসপাতালে দৌড়াতে হচ্ছিল আমাদের। কিন্তু সেখানে কোনো পরিষ্কার দিকনির্দেশনা পাচ্ছিলাম না। মনে হচ্ছিল একই বৃত্তে যেন ঘুরপাক খাচ্ছি। চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে আমাদের কাছে থাকা বাকি অর্থও শেষ হয়ে গেল। অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে পড়ল যে, বাচ্চাদের স্কুলের বেতনও দিতে পারছিলাম না।

এটা ছিল আমাদের জীবনের সবচেয়ে অন্ধকার অধ্যায়।

প্রতিবেশীদের অনুরোধে আমি মাঝে-মধ্যে জামা সেলাইয়ের কাজ করতাম। নিজে থেকেই এই কাজটা শিখেছিলাম। এ থেকে যে কয়টা টাকা পেতাম তা দিয়ে বাচ্চাদের জন্য ফল, বিস্কুট এসব কিনতে পারতাম। সেখান থেকেই শুরু।

সেই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে ব্র্যাকের গ্রাম উন্নয়ন কর্মসূচিতে যোগ দিলাম। সেখানে ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনার ওপর একটি সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হলো। প্রশিক্ষণের পরে একটি ক্ষুদ্রঋণ নিই।

এই টাকা খরচ করতে গিয়ে বিরাট দোলাচলের মধ্যে পড়ে গেলাম। কারণ, এক বছরের মধ্যেই মাসিক কিস্তিতে আমাকে টাকা ফেরত দিতে হবে। যদি সেটা দিতে না পারি?

যদি আমার ব্যবসা ঠিকঠাক না চলে—সেই ভয়ে ভবিষ্যতের কিস্তি পরিশোধ করতে তখনই ৫০০ টাকা আলাদা করে রাখলাম। বাচ্চাদেরকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে একদিন ছোট বোনকে সাথে নিয়ে ঢাকার ইসলামপুরে পাইকারি কাপড়ের বাজারে চলে গেলাম।

সেখানে সারিবদ্ধ শত শত কাপড়ের দোকান। ক্রেতা-বিক্রেতাদের অধিকাংশই পুরুষ, গোটা এলাকায় তাদের ভিড় আর ধাক্কাধাক্কি। পুরো এলাকায় ছড়িয়ে ছিল লিনেন, সুতি কাপড় আর ঘামের গন্ধ।

হাতের মুঠোয় ঋণের টাকা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেবল দেখেই যাচ্ছিলাম আমি। লোকজন কেমন করে যেন তাকাচ্ছিল। হঠাৎ গাঢ় কালোর ওপরে হালকা ধূসর রঙের ফুলের নকশা করা কাপড়ে আমার চোখ আটকে গেল। দোকানদার জানালেন, এটাকে “অরবিন্দ ভয়েল” বলা হয়। এটার মান ভালো, তুলনামূলক সস্তা এবং আরামদায়ক।

পনেরো মিনিট ধরে দামাদামি করলাম। বেশি দামে কিনে ঠকার সাধ্য আমার ছিল না। তাই আমি কেনার আগ্রহ নেই জানিয়ে চলে যাওয়ার ভান করি। কাপড়ের প্রকৃত দাম আমি জানি—আত্মবিশ্বাসের সাথে এমনটা জাহির করি। শেষ পর্যন্ত ছোটোখাটো একটা দরকষাকষির পরে আমার প্রায় ৬০০ টাকা বেঁচে গেল।

ফিরে এসে কাজে লেগে পড়লাম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা নোটবইতে আঁকিবুকি করে হিসাব করতে বসলাম কী দামে, কখন আমাকে পণ্য বিক্রি করতে হবে। অবশেষে সেলাই করতে শুরু করি। পরদিন ঝর্ণা ফেব্রিক্স যাত্রা শুরু করে। লোহার একটি রডে আমার তৈরি পোশাকগুলো ঝুলিয়ে রেখে পাশ দিয়ে যাওয়া কারও জন্য অপেক্ষা করতে থাকি।

আধা ঘণ্টারও কম সময়ে আমার প্রথম ক্রেতার দেখা পেয়ে যাই। প্রথম দিনেই তিন হাজার টাকার কাপড় বিক্রি করি। চারদিনে বিক্রি পৌঁছে যায় নয় হাজার টাকায়, যা আমার প্রাথমিক বিনিয়োগকে দ্বিগুণ করে দেয়।

বিক্রি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনায় নিজের সামর্থ্যের ওপর বিশ্বাস বাড়ছিল। তখন আমি আরও ঋণ নিয়ে কর্মী এবং সেলাই মেশিনে বিনিয়োগ করি।

ব্যবসা ক্রমশ বড় হতে থাকে। আমার তৈরি পোশাকের কাটিং, মেকিং, ডিজাইন ইত্যাদি নিয়ে এমন বড় বড় জায়গায় আলোচনা হচ্ছিল যেখানে কোনোদিনই যাইনি আমি।

২০০৫ সালে পাশের এলাকায় একটি টেক্সটাইল কারখানায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের এক সেমিনারে অংশ নেই। সেখানে নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত উপস্থিত ছিলেন। আমার কাজ তাঁর নজর কাড়ে। এরপর দূতাবাসের কর্মকর্তারা আমার কারখানায় আসতে শুরু করেন। সেসময় তাঁরা সবকিছুর ছবি তুলে নিয়ে যান।

তখন কি আর জানতাম যে, এলাকা ছাড়িয়ে আমার নাম পৌঁছে গেছে ভিনদেশের এক রানির কাছে!

রানি আসার ছয় মাস আগেই প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়।

আমার বাড়িতে আসার রাস্তা মেরামত করা হয়। বৃষ্টি হলে যাতে হাঁটতে সমস্যা না হয় সেজন্য উঁচু কাঠামো স্থাপন করা হয়। রাস্তা ঘিরে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ান পুলিশ কর্মকর্তারা। ২০১৪ সালে বড়দিনের আগে, ডিসেম্বরের শীতের একদিন রানি ম্যাক্সিমা প্রবেশ করেন ঝর্ণা ফেব্রিক্সের দরজা দিয়ে। তাঁকে আমার কাজ দেখানোর পাশাপাশি আমার সঙ্গে কাজ করা দারুণ মেধাবী মেয়েদের সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিলাম। তিনি আমাদের সাথে ৪৫ মিনিট ছিলেন, যা ছিল নির্ধারিত সময়সূচির চেয়ে কুড়ি মিনিট বেশি।

পরিদর্শনের কিছুদিনের মধ্যেই নেদারল্যান্ডস থেকে রানি বেশ কিছু আধুনিক সেলাই মেশিনের সাথে ফ্যাশন ডিজাইনার রোজম্যারিকেও পাঠান।

নারীদের প্রয়োজনকে কেন্দ্র করে আমরা পোশাক ডিজাইন করি। কঠিন কাজের সময়ও তারা যেন দিনভর আরামের পোশাক পরে থাকতে পারে, সেটাকে অগ্রাধিকার দিই আমরা। আলাদা আলাদা পোশাক সামলানো মেয়েদের জন্য যে কতটা কঠিন সেটা ক্রেতারা আমাকে প্রায়ই বলতেন। তখন আমি “একের ভেতরে তিন” একটি পোশাক নকশা করি, যা একসঙ্গে চাদর, হিজাব এবং ফেস মাস্কের কাজ করে। তাৎক্ষণিকভাবে পোশাকটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।

রানির প্রথম পরিদর্শনেই ঘটনার শেষ হয়নি। আমাদের মধ্যে যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। চার বছর পর তিনি আবার আসেন।

এখন আমার সংকট সমাধানের পথ নিজের কাছেই আছে। অন্যদের সমস্যা সমাধানেও আমি ঝর্ণা ফেব্রিক্সের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাই।

বর্তমানে এখানে ১৬জন নারী কাজ করেন। কোনো পুরুষ নেই। মেয়েরা তাদের ইচ্ছেমতো কাজ করতে পারে, বাচ্চাদের কাজে নিয়ে আসতে পারে, শিশুরা এখানে নাচতে পারে, গাইতে পারে। নিজেদেরকে এখানে ঢেকে রাখতে হয় না, কোনো গণ্ডির মাঝে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতে হয় না।

অর্থনৈতিক লেনদেনের দায়িত্বও তাদের ওপরেই থাকে, যা তাদেরকে মালিকানার অনুভূতি দেয়। তারা ক্রেতাদের থেকে টাকা সংগ্রহ করে, হিসাব রাখে; নিজেদের আয় নিজেদের কাছে রেখে বাকিটা আমাকে দেয়। বিশ্বাস এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এই ব্যবসার লাভের টাকা থেকে আমি দশজন শিক্ষার্থীর স্কুলের বেতন পরিশোধ করি। এদের দুইজন আমাদের কর্মীদের পরিবারের, বাকি আটজন প্রতিবেশী পরিবারের।

আমার স্বামী এখন আমার “ওয়ার্কিং পার্টনার”। আমার ছেলে সিঙ্গাপুরের একটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকৌশলে স্নাতক শেষ করে কাজ করছে বাংলাদেশের মেট্রোরেল প্রকল্পে।

ঝর্ণা ফেব্রিক্স আমার পরিচয়, উদ্দেশ্য, তরুণ নারীদের মেধা বিকশিত করার এক নিরাপদ জায়গা এবং আমার এলাকার শিশুদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। আমি অনেক মুনাফা চাই না। আমি একটি আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাই, নারীদের আত্মনির্ভরশীল হওয়ার পথটাকে সহজ করতে চাই। এ এক সময়সাপেক্ষ কাজ। কিন্তু তা অর্জনের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।