‘আগে সকাল বিকেলে পুকুরে অস্বাভাবিকভাবে খাবি খেত মাছ, ২-৩ দিন পর ভেসে উঠত মরা মাছ। তবে এখন এই আধুনিক এয়ারেটর (অক্সিজেন মেশিন) ব্যবহারের ফলে মাছ আর আগের মতো খাবি খায় না। মাছ মরার হারও প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে’- কথাগুলো বলছিলেন গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া উপজেলার ডুমুরিয়া ইউনিয়নের তারাইল গ্রামের বাসিন্দা সজিব বিশ্বাস।
সজিবের বাবা মুদি দোকানদার, সজিব স্থানীয় কলেজের বিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ২০২৩ সালে নিজের বাড়ির সামনের পুকুরে শখের বশে কৈ মাছ ছেড়েছিলেন তার বাবা। ৩ মাস পরে পুকুর থেকে বেশ ভাল পরিমাণ কৈ মাছ উৎপাদন হয় তাদের, যার ফলে কৈ চাষে ব্যাপক আগ্রহ জন্মায় সজিবের।
২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট (ইফাদ) ও ড্যানিস ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি (ড্যানিডা) এর অর্থায়নে, পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এর কারিগরি ও আর্থিক সহযোগিতায় এবং পদক্ষেপ মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র এর বাস্তবায়নে পরিচালিত আরএমটিপি প্রকল্পের সাথে যুক্ত হন সজিব।
সজিব বলেন, প্রথমে যশোরের হ্যাচারি মালিকদের কাছ থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকায় পৌনে তিন লাখ কৈ এর পোনা সংগ্রহ করি। পোনা ছাড়ার আগে পুকুরের চারপাশে জালের বেড়া দিই। এ ছাড়া পানির গুণাগুণ ঠিক রাখতে চুনও প্রয়োগ করি। সব মিলিয়ে খরচ হয় প্রায় আড়াই লাখ টাকা।
সজিব আরও বলেন, পদক্ষেপ-আরএমটিপি প্রকল্পের মাধ্যমে আমাকে একটা এয়ারেটর মেশিন অনুদান দেয়। এই মেশিনটাই আমাকে লাভের মুখ দেখিয়েছে। আগে যেখানে অক্সিজেনের অভাবে সবার মাছ মারা যেত, কিন্তু এই মেশিন স্থাপনের পরে আমার একটা মাছও মারা যায়নি, বরং মাছের স্বাস্থ্য আরও ভাল হয়েছে।
এ ছাড়াও আগে অক্সিজেনের অভাব পূরণ করতে চাষিরা স্যালো মেশিনের মাধ্যমে পানি ছিটিয়ে দিত। এতে তেল খরচ বেশি হতো এবং পরিশ্রমও বেশি। কিন্তু এই মেশিন ব্যবহারের ফলে আমার খরচটাও অনেকাংশে কমে গেছে।
সজিবের পুকুরে এখন দুই জন সবসময়ের জন্য কাজ করেন। তাদের খাবার ও বেতনসহ তিন মাসে প্রায় এক লাখ টাকা খরচ হয়। এছাড়াও ৩ মাসে প্রায় ৩৫০ মণ মাছের খাদ্য খাওয়ানো লাগে- যার বাজার মূল্য প্রায় ১২.৫ লাখ টাকা।
পুকুর মেরামত, পোনা এবং খাবারের খরচ সবমিলিয়ে ৩ মাসে সজিবের খরচ হয় প্রায় ১৬ লাখ টাকা। প্রথম ধাপে সজিবের পুকুর থেকে প্রায় ৩০০ মণ কৈ মাছ উৎপাদন হয়।
স্থানীয় বাজারে, আড়ৎদারদের কাছে প্রতি মণ ৭ হাজার ৫০০ টাকা হারে বিক্রি করে সজিব। এতে সজিবের আয় হয় প্রায় ২২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। সব খরচ বাদ দিয়ে ৩ মাসে সজিব আয় (লাভ) করেন প্রায় ৬.৫ লাখ টাকা।
টুঙ্গিপাড়া সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা দেবাশীষ বাছাড় বলেন, সঠিক পরিকল্পনা ও মানসম্মত মৎস্য পণ্য, ফিড, মেডিসিন, চুন, লবণ, খৈল ও অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করে সজিব বিশ্বাস সফলতার মুখ দেখেছেন যা আমার কর্ম এলাকা টুঙ্গিপাড়াসহ গোপালগঞ্জ জেলার সুনাম বয়ে এনেছে। এই অর্জনে পদক্ষেপ আরএমটিপি প্রকল্পের কর্মকর্তাবৃন্দের নিরলস পরিশ্রম প্রতিফলিত হয়েছে।
প্রকল্পের ভ্যালু চেইন ফ্যাসিলিটেটর (ভিসিএফ) কৃষিবিদ মো. লেমন মিয়া বলেন, সজিবের মতো স্থানীয় মৎস্য চাষিদের আধুনিক প্রযুক্তি, পানির প্যারামিটার, পুকুর ব্যাবস্থাপনা, প্রোবায়োটিক এর ব্যবহার এবং প্রাকৃতিক খাবারের ব্যাপারে আমরা সবসময় উৎসাহ দিয়ে থাকি।
নিরাপদ মৎস্য পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ নিশ্চিত করতে আমরা সাধারণ চাষিদের অন্যান্য সফল চাষিদের সঙ্গে সংযোগ করিয়ে দিই, যেন সঠিক ভ্যালু চেইন বজায় থাকে এবং সবাই উপকৃত হয়। সঙ্গে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট মাছচাষ ও মূল্য সংযোজিত মৎস্যপণ্য উৎপাদনসহ সকল প্রয়োজনীয় পরামর্শ অব্যাহত থাকবে।