ময়মনসিংহ , শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৯ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
নোটিশ :
প্রতিটি জেলা- উপজেলায় একজন করে ভিডিও প্রতিনিধি আবশ্যক। যোগাযোগঃ- Email- matiomanuss@gmail.com. Mobile No- 017-11684104, 013-03300539.

অর্ধেকের বেশি আসন ফাঁকা ১২ হাজার কারিগরি প্রিতিষ্ঠানে

  • স্টাফ রিপোর্টার
  • আপডেট সময় ০৯:১৮:৩৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • ২৩ বার পড়া হয়েছে

আন্তর্জাতিকভাবে কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা হয় কারিগরি শিক্ষাকে। উন্নত অনেক দেশে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষার্থীর হারও বেশি। কিন্তু বাংলাদেশে চাকরি না পেয়ে কারিগরি শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহ দিনদিন হারিয়ে ফেলছেন শিক্ষার্থীরা। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাড়লেও ধারাবাহিকভাবে কমছে শিক্ষার্থী।

দেশের ১২ হাজার কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গত পাঁচ বছর ধরে অর্ধেকের বেশি আসন ফাঁকা ছিল। এছাড়া, নতুন টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার (টিটিসি) প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষক এবং অধ্যক্ষের পদ অর্ধেক শূন্য রয়েছে। দেশীয় ও বৈশ্বিক শ্রমবাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কারিকুলাম প্রণয়নের তাগিদ দিয়ে শিক্ষাবিদরা বলেন, দেশে কারিগরি শিক্ষার অবকাঠামো সম্প্রসারণ হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার মান নিশ্চিত করা যায়নি।

দেশে উন্নত প্রযুক্তি ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে এক দশকে বিনিয়োগ হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কারিগরি শিক্ষা খাতেও বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প নেওয়া হয়। এর মধ্যে অন্যতম ৪২৯টি উপজেলায় ৪২৯টি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ (টিএসসি) নির্মাণের দুটি প্রকল্প। একটি প্রকল্পে ১০০টি এবং আরেকটি প্রকল্পের অধীন নির্মাণ হচ্ছে ৩২৯টি প্রতিষ্ঠান। চলতি বছর পর্যন্ত এগুলোর মধ্যে ৯১টি টিএসসিতে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৫০ শতাংশ শিক্ষকের পদ শূন্য। প্রয়োজনীয় সংখ্যক দক্ষ শিক্ষক ও প্রচারণার অভাবসহ বিভিন্ন কারণে এ প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর পর এখন পর্যন্ত কোনো শিক্ষাবর্ষেই আসন সংখ্যা অনুযায়ী শিক্ষার্থী পায়নি। প্রকল্প দুটির মেয়াদ চলতি বছরের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা।

শ্রমবাজারের চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে কারিগরি শিক্ষায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে না :কারিগরি অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানগুলোয় ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের প্রি-ভোকেশনাল এবং নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত কমপক্ষে চারটি করে ট্রেডে পড়াশোনা করানো হয়। এছাড়া, এসএসসি (ভোকেশনাল) ও এইচএসসি (ভোকেশনাল) কোর্সসহ বিভিন্ন ট্রেডের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বর্তমানে সব কোর্স চালু আছে এমন প্রতিষ্ঠানে বেশির ভাগ আসন ফাঁকা থাকছে। আগের ৬৪টিসহ বর্তমানে ১৫৫টি টিএসসির কার্যক্রম চালু রয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ৪২৯টি টিএসসি নির্মাণে ব্যয় হবে মোট ২৩ হাজার ৪৬ কোটি টাকা। আওয়ামী সরকারের আমলে দুই দফায় সংশোধনের মাধ্যমে প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানো হয়েছে।

কারিগরি শিক্ষার মান না বাড়িয়ে নতুন প্রতিষ্ঠান নির্মাণের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের একজন অধ্যাপক বলেন, ‘বর্তমান প্রেক্ষাপটে কারিগরি শিক্ষায় দক্ষতা বাড়ানো খুবই জরুরি। শ্রমবাজারের চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে কারিগরি শিক্ষায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে না। উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাবে এ খাতের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ছাত্ররা পিছিয়ে পড়ছে।’ তিনি  আরো বলেন, ‘নতুন প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে বাজারের চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে নেওয়া হচ্ছে কি না, এতে কী ধরনের কারিকুলাম হবে, বৃত্তিমূলক শিক্ষার পাশাপাশি আদর্শ শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে কি না এবং যন্ত্রপাতিগুলো আধুনিক কি না, সে বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা দরকার।’

১০০ টিএসসি নির্মাণে দুই বছরের প্রকল্প ১০ বছরেও শেষ হয়নি :জানা গেছে, ১০০টি উপজেলায় একটি করে টিএসসি নির্মাণের প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছিল ২০১৪ সালে। ঐ সময় প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯২৪ কোটি টাকা। ২০১৬ সালের জুনের মধ্যে এসব টিএসসি নির্মাণ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের সিকিভাগও বাস্তবায়িত না হওয়ায় বাড়ানো হয় বরাদ্দের পরিমাণ ও মেয়াদ। দুই বছর মেয়াদের সে প্রকল্প ২০২৫ সালে এসেও শেষ হয়নি। সম্প্রতি কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে প্রকল্পটির তৃতীয় সংশোধনের প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। এ নিয়ে ১২ আগস্ট পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা (পিইসি) অনুষ্ঠিত হয়েছে।

সভায় প্রকল্পটির মেয়াদ আরো দুই বছর বাড়িয়ে ২০২৭ সালের জুন পর্যন্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এক্ষেত্রে ব্যয় বাড়ানোরও প্রস্তাব করায় প্রকল্পটির ব্যয় দাঁড়াবে ২ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা। পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত এ প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে বাস্তবায়ন অগ্রগতি ছিল ৭৬ দশমিক ২৩ শতাংশ। এদিকে, ২০১৪ সালের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন শেষ না করেই ২০২০ সালের জানুয়ারিতে আরো ৩২৯টি টিএসসি নির্মাণের উদ্যোগ নেয় তত্কালীন সরকার। সমসংখ্যক উপজেলায় এসব প্রতিষ্ঠান নির্মাণ হওয়ার কথা। এক্ষেত্রে প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। ব্যয় ধরা হয়েছিল ২০ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, এ প্রকল্পেরও মেয়াদ বৃদ্ধির প্রয়োজন হতে পারে।

জনশক্তি রপ্তানির অর্ধেকের বেশি অদক্ষ :কারিগরি শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য বিদেশি শ্রমবাজারের জন্য দক্ষ কর্মী তৈরির মাধ্যমে রেমিট্যান্স আয় বৃদ্ধি। তবে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) এক প্রতিবেদন বলছে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে কর্মী গেছেন ১০ লাখ ১১ হাজার ৯৬৯ জন। তাদের মধ্যে দক্ষ কর্মীর সংখ্যা মাত্র ২ লাখ ১৪ হাজার ৪৪, যা গত বছর মোট বিদেশগামী কর্মীর ২৩ দশমিক ৬২ শতাংশ। একই সময়ে স্বল্পদক্ষ কর্মী (অদক্ষ) হিসেবে বিদেশে গেছেন ৪ লাখ ৯১ হাজার ৪৮০ জন বা ৫৪ দশমিক ২৩ শতাংশ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জনশক্তি রপ্তানির অর্ধেকের বেশি অদক্ষ বা স্বল্পদক্ষ কর্মী হিসেবে বিদেশে যাচ্ছেন। এছাড়া, আধাদক্ষ কর্মী হিসেবে বিদেশে গেছেন ১ লাখ ৫৯ হাজার ১২৮ জন বা ১৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ।

নতুন প্রযুক্তির অভাবের কথা স্বীকার করলেন শিক্ষা উপদেষ্টা : শিক্ষা উপদেষ্টা চৌধুরী রফিকুল আবরার (সি আর আবরার) গত ২৮ এপ্রিল রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘কারিগরি শিক্ষা দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত, এখানে কাঠামোগত সংস্কার দরকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ট্রেডভিত্তিক শিক্ষকের ঘাটতি এবং প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও নতুন প্রযুক্তির অভাব আছে। এসব দূর করার জন্য কারিগরি শিক্ষাকে আরো যুগোপযোগী করার পদক্ষেপ নিতে হবে।

অভিভাবকরা এখনো মেধাবী সন্তানকে কারিগরি প্রতিষ্ঠানে পড়াতে চান না : বোর্ড চেয়ারম্যান : কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিপুলসংখ্যক আসন ফাঁকা থাকার বিষয়ে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রুহুল আমিন সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, ‘চীনসহ যেসব দেশের অর্থনীতি দ্রুততম সময়ে বিকশিত হয়েছে, যেসব রাষ্ট্র দ্রুত উন্নতি করেছে, তারা সবাই কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমেই তা সম্ভব করেছে।

বাংলাদেশকেও উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হতে হলে কারিগরি শিক্ষায় জোর দিতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে এ কারণেই প্রতিষ্ঠান বাড়ানো হচ্ছে। তবে আমাদের এখানে শিক্ষক সংকট, প্রচারণার ঘাটতি, কারিগরি শিক্ষার বিষয়ে জনসচেতনতার অভাবসহ বেশকিছু সংকট রয়েছে, যা কারিগরি শিক্ষার প্রসারে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে। বিশেষত কারিগরি শিক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের নেতিবাচক ধারণা এক্ষেত্রে একটি বড় বাধা। বেশির ভাগ মানুষই এ শিক্ষার যথাযথ প্রয়োগ ও গুরুত্ব সম্পর্কে অবগত নন। তারা মনে করেন, এটি কম মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য।

প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তদারকি ও মূল্যায়ন কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে :শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, পৃথিবীর উন্নত বিশ্বের দেশগুলো যেমন চীন, জাপান, জার্মানি এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারত কারিগরি শিক্ষার ওপর জোর দিয়ে সর্বোচ্চ ফলাফল নিশ্চিত করতে পেরেছে। আমাদের দেশেও প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরির মানোন্নয়নের বিষয়টি খুব গুরুত্ব সহকারে দেখছি।

এই নিয়ে বেশ কয়েকটি ওয়ার্কশপ করে কার্যকর পদক্ষেপ নেব। এছাড়া, পলিটেকনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার চিন্তাভাবনা করছি। আগে থেকে চলমান নানা প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন করে শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে অবকাঠামো উন্নয়ন, কারিকুলাম আধুনিকায়ন, ভর্তি নীতিমালায় পরিবর্তন এবং শিল্প খাতের সঙ্গে কার্যকর সংযোগ স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তদারকি ও মূল্যায়ন কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে।

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সঞ্চয় করে রাখুন

আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

অর্ধেকের বেশি আসন ফাঁকা ১২ হাজার কারিগরি প্রিতিষ্ঠানে

আপডেট সময় ০৯:১৮:৩৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

আন্তর্জাতিকভাবে কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা হয় কারিগরি শিক্ষাকে। উন্নত অনেক দেশে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষার্থীর হারও বেশি। কিন্তু বাংলাদেশে চাকরি না পেয়ে কারিগরি শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহ দিনদিন হারিয়ে ফেলছেন শিক্ষার্থীরা। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাড়লেও ধারাবাহিকভাবে কমছে শিক্ষার্থী।

দেশের ১২ হাজার কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গত পাঁচ বছর ধরে অর্ধেকের বেশি আসন ফাঁকা ছিল। এছাড়া, নতুন টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার (টিটিসি) প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষক এবং অধ্যক্ষের পদ অর্ধেক শূন্য রয়েছে। দেশীয় ও বৈশ্বিক শ্রমবাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কারিকুলাম প্রণয়নের তাগিদ দিয়ে শিক্ষাবিদরা বলেন, দেশে কারিগরি শিক্ষার অবকাঠামো সম্প্রসারণ হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার মান নিশ্চিত করা যায়নি।

দেশে উন্নত প্রযুক্তি ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে এক দশকে বিনিয়োগ হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কারিগরি শিক্ষা খাতেও বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প নেওয়া হয়। এর মধ্যে অন্যতম ৪২৯টি উপজেলায় ৪২৯টি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ (টিএসসি) নির্মাণের দুটি প্রকল্প। একটি প্রকল্পে ১০০টি এবং আরেকটি প্রকল্পের অধীন নির্মাণ হচ্ছে ৩২৯টি প্রতিষ্ঠান। চলতি বছর পর্যন্ত এগুলোর মধ্যে ৯১টি টিএসসিতে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৫০ শতাংশ শিক্ষকের পদ শূন্য। প্রয়োজনীয় সংখ্যক দক্ষ শিক্ষক ও প্রচারণার অভাবসহ বিভিন্ন কারণে এ প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর পর এখন পর্যন্ত কোনো শিক্ষাবর্ষেই আসন সংখ্যা অনুযায়ী শিক্ষার্থী পায়নি। প্রকল্প দুটির মেয়াদ চলতি বছরের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা।

শ্রমবাজারের চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে কারিগরি শিক্ষায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে না :কারিগরি অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানগুলোয় ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের প্রি-ভোকেশনাল এবং নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত কমপক্ষে চারটি করে ট্রেডে পড়াশোনা করানো হয়। এছাড়া, এসএসসি (ভোকেশনাল) ও এইচএসসি (ভোকেশনাল) কোর্সসহ বিভিন্ন ট্রেডের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বর্তমানে সব কোর্স চালু আছে এমন প্রতিষ্ঠানে বেশির ভাগ আসন ফাঁকা থাকছে। আগের ৬৪টিসহ বর্তমানে ১৫৫টি টিএসসির কার্যক্রম চালু রয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ৪২৯টি টিএসসি নির্মাণে ব্যয় হবে মোট ২৩ হাজার ৪৬ কোটি টাকা। আওয়ামী সরকারের আমলে দুই দফায় সংশোধনের মাধ্যমে প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানো হয়েছে।

কারিগরি শিক্ষার মান না বাড়িয়ে নতুন প্রতিষ্ঠান নির্মাণের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের একজন অধ্যাপক বলেন, ‘বর্তমান প্রেক্ষাপটে কারিগরি শিক্ষায় দক্ষতা বাড়ানো খুবই জরুরি। শ্রমবাজারের চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে কারিগরি শিক্ষায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে না। উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাবে এ খাতের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ছাত্ররা পিছিয়ে পড়ছে।’ তিনি  আরো বলেন, ‘নতুন প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে বাজারের চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে নেওয়া হচ্ছে কি না, এতে কী ধরনের কারিকুলাম হবে, বৃত্তিমূলক শিক্ষার পাশাপাশি আদর্শ শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে কি না এবং যন্ত্রপাতিগুলো আধুনিক কি না, সে বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা দরকার।’

১০০ টিএসসি নির্মাণে দুই বছরের প্রকল্প ১০ বছরেও শেষ হয়নি :জানা গেছে, ১০০টি উপজেলায় একটি করে টিএসসি নির্মাণের প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছিল ২০১৪ সালে। ঐ সময় প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯২৪ কোটি টাকা। ২০১৬ সালের জুনের মধ্যে এসব টিএসসি নির্মাণ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের সিকিভাগও বাস্তবায়িত না হওয়ায় বাড়ানো হয় বরাদ্দের পরিমাণ ও মেয়াদ। দুই বছর মেয়াদের সে প্রকল্প ২০২৫ সালে এসেও শেষ হয়নি। সম্প্রতি কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে প্রকল্পটির তৃতীয় সংশোধনের প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। এ নিয়ে ১২ আগস্ট পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা (পিইসি) অনুষ্ঠিত হয়েছে।

সভায় প্রকল্পটির মেয়াদ আরো দুই বছর বাড়িয়ে ২০২৭ সালের জুন পর্যন্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এক্ষেত্রে ব্যয় বাড়ানোরও প্রস্তাব করায় প্রকল্পটির ব্যয় দাঁড়াবে ২ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা। পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত এ প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে বাস্তবায়ন অগ্রগতি ছিল ৭৬ দশমিক ২৩ শতাংশ। এদিকে, ২০১৪ সালের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন শেষ না করেই ২০২০ সালের জানুয়ারিতে আরো ৩২৯টি টিএসসি নির্মাণের উদ্যোগ নেয় তত্কালীন সরকার। সমসংখ্যক উপজেলায় এসব প্রতিষ্ঠান নির্মাণ হওয়ার কথা। এক্ষেত্রে প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। ব্যয় ধরা হয়েছিল ২০ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, এ প্রকল্পেরও মেয়াদ বৃদ্ধির প্রয়োজন হতে পারে।

জনশক্তি রপ্তানির অর্ধেকের বেশি অদক্ষ :কারিগরি শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য বিদেশি শ্রমবাজারের জন্য দক্ষ কর্মী তৈরির মাধ্যমে রেমিট্যান্স আয় বৃদ্ধি। তবে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) এক প্রতিবেদন বলছে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে কর্মী গেছেন ১০ লাখ ১১ হাজার ৯৬৯ জন। তাদের মধ্যে দক্ষ কর্মীর সংখ্যা মাত্র ২ লাখ ১৪ হাজার ৪৪, যা গত বছর মোট বিদেশগামী কর্মীর ২৩ দশমিক ৬২ শতাংশ। একই সময়ে স্বল্পদক্ষ কর্মী (অদক্ষ) হিসেবে বিদেশে গেছেন ৪ লাখ ৯১ হাজার ৪৮০ জন বা ৫৪ দশমিক ২৩ শতাংশ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জনশক্তি রপ্তানির অর্ধেকের বেশি অদক্ষ বা স্বল্পদক্ষ কর্মী হিসেবে বিদেশে যাচ্ছেন। এছাড়া, আধাদক্ষ কর্মী হিসেবে বিদেশে গেছেন ১ লাখ ৫৯ হাজার ১২৮ জন বা ১৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ।

নতুন প্রযুক্তির অভাবের কথা স্বীকার করলেন শিক্ষা উপদেষ্টা : শিক্ষা উপদেষ্টা চৌধুরী রফিকুল আবরার (সি আর আবরার) গত ২৮ এপ্রিল রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘কারিগরি শিক্ষা দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত, এখানে কাঠামোগত সংস্কার দরকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ট্রেডভিত্তিক শিক্ষকের ঘাটতি এবং প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও নতুন প্রযুক্তির অভাব আছে। এসব দূর করার জন্য কারিগরি শিক্ষাকে আরো যুগোপযোগী করার পদক্ষেপ নিতে হবে।

অভিভাবকরা এখনো মেধাবী সন্তানকে কারিগরি প্রতিষ্ঠানে পড়াতে চান না : বোর্ড চেয়ারম্যান : কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিপুলসংখ্যক আসন ফাঁকা থাকার বিষয়ে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রুহুল আমিন সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, ‘চীনসহ যেসব দেশের অর্থনীতি দ্রুততম সময়ে বিকশিত হয়েছে, যেসব রাষ্ট্র দ্রুত উন্নতি করেছে, তারা সবাই কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমেই তা সম্ভব করেছে।

বাংলাদেশকেও উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হতে হলে কারিগরি শিক্ষায় জোর দিতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে এ কারণেই প্রতিষ্ঠান বাড়ানো হচ্ছে। তবে আমাদের এখানে শিক্ষক সংকট, প্রচারণার ঘাটতি, কারিগরি শিক্ষার বিষয়ে জনসচেতনতার অভাবসহ বেশকিছু সংকট রয়েছে, যা কারিগরি শিক্ষার প্রসারে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে। বিশেষত কারিগরি শিক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের নেতিবাচক ধারণা এক্ষেত্রে একটি বড় বাধা। বেশির ভাগ মানুষই এ শিক্ষার যথাযথ প্রয়োগ ও গুরুত্ব সম্পর্কে অবগত নন। তারা মনে করেন, এটি কম মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য।

প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তদারকি ও মূল্যায়ন কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে :শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, পৃথিবীর উন্নত বিশ্বের দেশগুলো যেমন চীন, জাপান, জার্মানি এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারত কারিগরি শিক্ষার ওপর জোর দিয়ে সর্বোচ্চ ফলাফল নিশ্চিত করতে পেরেছে। আমাদের দেশেও প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরির মানোন্নয়নের বিষয়টি খুব গুরুত্ব সহকারে দেখছি।

এই নিয়ে বেশ কয়েকটি ওয়ার্কশপ করে কার্যকর পদক্ষেপ নেব। এছাড়া, পলিটেকনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার চিন্তাভাবনা করছি। আগে থেকে চলমান নানা প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন করে শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে অবকাঠামো উন্নয়ন, কারিকুলাম আধুনিকায়ন, ভর্তি নীতিমালায় পরিবর্তন এবং শিল্প খাতের সঙ্গে কার্যকর সংযোগ স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তদারকি ও মূল্যায়ন কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে।