একসময় তিনি ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির এক পরিচিত মুখ; এক বিপ্লবী নেতার কন্যা, যার রাজনৈতিক উত্থানের গল্প শুরু হয়েছিল ১৯৭০–এর দশকে বাবার নির্মম হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে। সেখান থেকে ক্ষমতার শীর্ষে ওঠা, আবার সেখান থেকেই এক অবিশ্বাস্য পতনে দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়া—শেখ হাসিনার রাজনৈতিক যাত্রা এখন নতুন এক অন্ধকার অধ্যায়ে থেমে আছে।
তিনি বর্তমানে ভারতে নির্বাসিত। সেই অবস্থাতেই তার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা হয়েছে। নয়াদিল্লি তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠালে যে কোনো সময় এই দণ্ড কার্যকর হতে পারে।
এখন তিনি দুই দেশের মধ্যে এক জটিল অচলাবস্থার কেন্দ্রবিন্দু—ঢাকা তাকে বিচারের মুখোমুখি করতে প্রত্যর্পণের দাবি জানাচ্ছে, আর তিনি দাবি করে যাচ্ছেন, এই অভিযোগগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং তিনি এসব অপরাধ করেননি।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মোবাশ্বার হাসান বলেন, ‘গণরোষ থেকে বাঁচতেই তাকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। তিনি ভারতে লুকিয়ে আছেন, আর তার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হলো—এ এক ব্যতিক্রমী গল্প।’
তার (হাসিনার) ভাষায়, ‘তাকে পালাতে হয়েছিল—এটা নিজের অপরাধেরই একটি স্বীকারোক্তি। জনগণ, বিভিন্ন বাহিনী—সবাই তার বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল। কারণ, তিনি সীমা অতিক্রম করেছিলেন। তিনি হত্যা করেছেন, তার নির্দেশে অনেক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।’
সহিংস অতীত থেকে ক্ষমতার লম্বা যাত্রা
শেখ হাসিনার রাজনৈতিক গল্প বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা হিসেবে তিনি দেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম প্রত্যক্ষ করেছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের আগস্টের সেই রক্তাক্ত রাত পুরো জীবনকে পাল্টে দেয়। ঢাকার বাসভবনে সেনা কর্মকর্তাদের হাতে তার বাবা, মা ও তিন ভাই নিহত হন। তিনি ও তার বোন তখন পশ্চিম জার্মানিতে থাকায় প্রাণে বাঁচেন।
সে সময় ক্ষমতায় আসেন জেনারেল জিয়াউর রহমান—যিনি পরবর্তীতে শেখ হাসিনার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী খালেদা জিয়ার স্বামী। নতুন সরকার এমন আইন পাস করেছিল, যা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের দীর্ঘদিন সুরক্ষা দিয়েছিল। এই ট্র্যাজেডিই তাকে ছয় বছরের বাধ্যতামূলক নির্বাসনে ঠেলে দেয়, আর একই সঙ্গে ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতার অনুভূতি গেঁথে দেয় তার মনে।
১৯৮১ সালে দেশে ফিরে তিনি দেখতে পান—বাংলাদেশ তখন ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের প্রতি দৃঢ় অবস্থানে দাঁড়ানো, এবং তিনি প্রবেশ করছেন এমন এক রাজনৈতিক অঙ্গনে, যা নির্ধারিত হতে যাচ্ছে আরেক নারীর ট্র্যাজেডিগাঁথা জীবনের দ্বারা। তিনি খালেদা জিয়া। এই দ্বন্দ্বই পরবর্তী তিন দশকে দেশের রাজনীতিকে গভীরভাবে বিভক্ত করে রাখে।
সেই দিনটির কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘বিমানবন্দরে নেমে কোনো আত্মীয়কে পাইনি, কিন্তু লাখো মানুষের ভালোবাসা পেয়েছিলাম—সেটাই ছিল আমার শক্তি।’
ক্ষমতার তুঙ্গ, শাসনের বিতর্ক
১৯৯৬ সালে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি ১৯৭৫ সালের হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরুর ঘোষণা দেন। এক মেয়াদ শেষে ক্ষমতা হারিয়ে ২০০৮ সালে আবার সরকার গঠন করলে তাকে এক বদলে যাওয়া নেত্রী হিসেবে দেখা যায়—আরও কঠোর, আরও সতর্ক, এবং নিজের অবস্থান অটুট রাখায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
তার শাসনামলে দ্রুত অর্থনৈতিক অগ্রগতি ঘটে, ভারত–বাংলাদেশ সহযোগিতা গভীরতর হয়। তবে এরই মধ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ, বিরোধীদের ওপর দমন–পীড়ন, নির্বাচন নিয়ে অনিয়ম, ও একদলীয় শাসনের দিকে অগ্রসর হওয়া নিয়ে দেশ–বিদেশে সমালোচনা বাড়তে থাকে।
ভারতের একটি দৈনিক সাম্প্রতিক এক সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করে যে চাপ বাড়লে তিনি ‘ভারতের পূর্ণ সমর্থনের ওপর নির্ভর করতে পারতেন’। কিন্তু দেশের ভেতরে তার ভাবমূর্তিতে দমন–পীড়নের ছাপ গভীর হয়। মোবাশ্বার হাসান বলেন, ‘ক্ষমতায় থাকতে গিয়ে তিনি ব্যাপক রক্তপাত ঘটিয়েছেন।’
শেষ পর্যন্ত পতন
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলন দ্রুতই জাতীয় গণ–আন্দোলনে রূপ নেয়। জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরের হিসেবে, আন্দোলন দমনে অন্তত ১৪০০ মানুষের মৃত্যু ঘটে। কিন্তু এই সহিংসতা আন্দোলন থামাতে পারেনি; বরং আরও প্রবল করে তোলে, এবং শেষ পর্যন্ত তার সরকার পতনের মুখে পড়ে।
মোবাশ্বার হাসান বলেন, ‘জনগণ এবং বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনী পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল।’
মৃত্যুদণ্ড ও নতুন অচলাবস্থা
ভারতে রাজনৈতিক শরণার্থী হিসেবে তার বর্তমান জীবন তাকে আবারও এক পুরোনো অবস্থায় ফিরিয়ে এনেছে—প্রায় অর্ধশতাব্দী আগের নির্বাসনের মতো। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার অনুপস্থিতিতেই বিচার চলে এবং তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। অভিযোগ—বিক্ষোভকারীদের হত্যায় উসকানি, ফাঁসির নির্দেশ, এবং দমন–পীড়নে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের অনুমোদন।
রায় ঘোষণার পর আদালতকক্ষে করতালি পড়ে। এক ভুক্তভোগীর বাবা আবদুর রব বলেন, ‘রায় আমাদের কিছুটা শান্তি দিয়েছে। তবে তার গলায় দড়ি না নাড়ানো পর্যন্ত আমাদের শান্তি মিলবে না।’
ভারতও মৃত্যুদণ্ড দেয়—তাই তার ভবিষ্যৎ কার্যত নয়াদিল্লির সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। ভারত বলেছে, তারা রায় পর্যবেক্ষণ করছে এবং বাংলাদেশের সব পক্ষের সঙ্গে গঠনমূলকভাবে যুক্ত থাকবে। তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় জানিয়েছেন, ‘এই সংকটে ভারতই মূলত আমার মায়ের জীবন বাঁচিয়েছে।’
ভারতের সামনে কঠিন সিদ্ধান্ত
দশকের পর দশক শেখ হাসিনা ছিলেন ভারতের সবচেয়ে দৃঢ় আঞ্চলিক মিত্রদের একজন। বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান থেকে সীমান্ত নিরাপত্তা—সব ক্ষেত্রেই তিনি নয়াদিল্লির ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এখন তার পতনে ভারত উদ্বিগ্ন যে অঞ্চলে উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো আবার সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে।
ভারতে দায়িত্ব পালন করা সাবেক কূটনীতিক অনিল ত্রিগুণায়েত মনে করেন—ভারত সম্ভবত তাকে ফেরত পাঠাবে না, কারণ অভিযোগগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দেখানোর সুযোগ রয়েছে। দুই দেশের প্রত্যর্পণ চুক্তিতেই ‘রাজনৈতিক অপরাধের’ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম রয়েছে।
তার মতে, ‘যেহেতু সব আইনি প্রতিকার শেষ হয়নি, তাই ভারত তাকে পাঠাতে তাড়াহুড়া করবে না।’
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশ্য রায় ঘোষণার দিনই তাকে ‘বিলম্ব না করে’ হস্তান্তরের আহ্বান জানায়।
আগামী দিনের অনিশ্চয়তা
মৃত্যুদণ্ডের রায় বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনের আগে এক উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়ায় এবং নেতৃত্ব ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে কঠিন রাজনৈতিক ধাক্কা সামাল দেওয়ার বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে।
প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর সামনে সুযোগ তৈরি হলেও গভীর বিভেদ সহজে কাটবে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। মোবাশ্বার হাসান বলেন, ‘বাংলাদেশ এখনো মিলেমিশে চলার মতো অবস্থায় নেই।’ তার মতে, আওয়ামী লীগ হয়তো ফিরে আসার পথ খুঁজবে—তবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নয়।
শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটা রয়ে যায়—শেখ হাসিনার বিদায়ে কি এক দীর্ঘ, বিভাজনময় যুগের সমাপ্তি ঘটবে, নাকি বাংলাদেশ প্রবেশ করবে আরও অনিশ্চিত এক নতুন অধ্যায়ের দিকে?

ডিজিটাল ডেস্ক 























