যদি জানা যায়, অতীতে আমাদের পূর্বপুরুষদের কোনো এক দেশ থেকে বন্দি করে এনে ক্রীতদাস হিসাবে অন্য জায়গায় বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল- তাহলে ওই দেশের প্রতি, শেকড়ের সেই সংযোগ নিয়ে কেমন অনুভূতি হবে?
কয়েক শতাব্দী আগে দাস ব্যবসার অন্যতম কেন্দ্র হিসাবে পরিচিত ছিল পশ্চিম আফ্রিকার দেশ বেনিন। সেখান থেকে তো বটেই, আশপাশের অঞ্চল থেকেও মানুষকে বন্দি করে এনে দাস হিসাবে বিক্রি করে দেওয়া হতো বিভিন্ন দেশে।
বেনিনের নতুন সরকারের চালু করা এই আইনের নাম ‘মাই অ্যাফ্রো অরিজিনস’।
টনিয়া লুইস লি-র পূর্বপুরুষদের বেনিন থেকে বন্দি করে এনে দাস হিসাবে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল।
বেনিনস্থিত ভিদা বন্দর একসময় দাস ব্যবসার প্রধান কেন্দ্র ছিল। লাখ লাখ আফ্রিকান ক্রীতদাসকে আমেরিকান মহাদেশে পাঠানোর আগে এখানে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হতো।
ঘানা, সিয়েরা লিওন এবং গিনি-বিসাউয়ের মতো আফ্রিকান দেশগুলো এখন কোনো একসময় সেখান থেকে নিয়ে দাস হিসাবে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের বংশধরদের নাগরিকত্ব দেয়।
তবে বেনিন একদিকে যেমন এই উদ্যোগের মাধ্যমে বহু শতাব্দী আগে বাস্তুচ্যুত পরিবারের বংশধরদের ফেরাতে এবং সে দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে চায়, তেমনই চায় প্রতিভা এবং মূলধনকে আকর্ষণ করতে।
এখন প্রশ্ন হলো বেনিন কি সত্যিই সেই সমস্ত মানুষদের ফিরিয়ে আনতে পারবে যাদের পূর্বপুরুষদের সঙ্গে এক সময় সে দেশের শিকড়ের যোগ ছিল?
‘মিডল প্যাসেজ’
ষোড়শ শতাব্দী থেকে উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত, এক কোটিরও বেশি মানুষকে এইভাবে জোর করে বন্দি করার পর নৌকা করে আটলান্টিক মহাসাগর পার করানো হয়। মূলত পশ্চিম আফ্রিকার অঞ্চল থেকে মানুষকে বন্দি করে আনা হতো, তাদের রাখা হতো দাস ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ইউরোপীয়দের উপকূলীয় কারাগারে।
এদের মধ্যে ৯০ শতাংশেরও বেশি ব্যক্তিদের ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ এবং দক্ষিণ আমেরিকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
অতীতের দাহোমি সাম্রাজ্য যা বর্তমানের বেনিন, এই পশ্চিমা দাস ব্যবসায়ীদের সক্রিয়ভাবে সমর্থন করেছিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের আফ্রিকান-আমেরিকান স্টাডিজের অ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসর ড. বায়ও হোলসি ব্যাখ্যা করেছেন, “ডাহোমি সাম্রাজ্যের সৈন্যরা উপজাতি এবং প্রতিবেশী দেশ থেকে লোকজনকে বন্দি করে আনত”।
দাহোমি সাম্রাজ্যে প্রশিক্ষিত এবং শক্তিশালী সেনাবাহিনী ছিল। প্রতিবেশী অঞ্চলগুলো দখল করার জন্য ক্রমাগত আক্রমণ চালাত তারা। যুদ্ধবন্দিদের রাজার সম্পত্তি হিসাবে বিবেচনা করা হতো এবং উপকরণ, অস্ত্র ইত্যাদির বিনিময়ে ইউরোপীয় দাস ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হতো এই বন্দিদের।
ড. হোলসি বলেন, “ইউরোপীয়রা আফ্রিকায় বন্দুক ও গোলাবারুদ নিয়ে আসার পর আফ্রিকায় যুদ্ধের প্রকৃতি বলদে যায়। দাহোমি সাম্রাজ্য ইউরোপীয় অস্ত্র ব্যবহার করে প্রতিবেশী অঞ্চলগুলো জয় করতে শুরু করে। একইসঙ্গে আরো বেশি পরিমাণে সেখান থেকে লোকজন বন্দি করে এনে পশ্চিমা দাস ব্যবসায়ীদের কাছে হস্তান্তর করা শুরু করে”।
“এতে কিন্তু দুই পক্ষই লাভবান হয়েছে। এই অস্ত্রের সাহায্যে, দাহোমি সাম্রাজ্য তার নিজেদের সম্প্রদায়কে দাসত্ব থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিল এবং একই সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে সম্পদও সংগ্রহ করে।”
দাস হিসাবে আফ্রিকানদের আমেরিকা এবং লাতিন আমেরিকায় খনি, তামাক তৈরি এবং আখের ক্ষেতে কাজ করার জন্য পাঠানো হয়েছিল। পরবর্তীকালে এই ফসল আবার ইউরোপে বিক্রি করা হতো।
সমুদ্র পেরিয়ে ক্রীতদাসদের বন্দি করে পাঠানোর এই প্রক্রিয়াকে বলা হত ‘মিডল প্যাসেজ’ বা মধ্য পথ।
ড. হোলসি ব্যাখ্যা করেছেন, “দাস ব্যবসা মূলত শুরু করেছিল ইউরোপীয়রা। তারা তাদের নৌকায় করে মানুষকে বন্দি করে দাস বানিয়ে নিয়ে যেত”।
“এই মিডল প্যাসেজের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল ইউরোপীয় বণিকদের। পরে এই বন্দিদের দাস হিসাবে মার্কিন বাজারে আরও একবার বিক্রি করা হতো, যাদের দিয়ে খামার বা বাগানে কাজ করানো হতো”।
শতাব্দী ধরে চলা এই ব্যবসা পশ্চিম আফ্রিকায় গভীর প্রভাব ফেলে। সুস্থ-সবল এবং তরুণ জনগোষ্ঠীকে জোর করে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার কারণে পশ্চিম আফ্রিকায় শ্রমিকের তীব্র ঘাটতি দেখা দেয়।
ড. হোলসি ব্যাখ্যা করেছেন, “দাস ব্যবসা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাপড়, বাসন এবং অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী শিল্পগুলো ধীরে ধীরে নষ্ট হতে থাকে। এই ব্যবসা সহিংসতা ও যুদ্ধকেও উৎসাহিত করে”।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে দাস ব্যবসা নিষিদ্ধ করা হয়। তবে এর পর ইউরোপীয় দেশগুলো আফ্রিকান অঞ্চল দখল করার কাজ শুরু করে, যা অব্যাহত ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু পর্যন্ত।
প্রধানত ব্রিটেন এবং ফ্রান্স আফ্রিকার বেশিরভাগ অংশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়। এর ফলে সেখানকার সমাজ ও অর্থনীতিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল, যার প্রভাব আজও দেখা যায়।
প্রত্যাবর্তন
দাস হিসেবে বন্দিদের অধিকাংশকেই আটলান্টিক মহাসাগর পার করে নিয়ে যাওয়া হতো। তবে ক্রীতদাসের বৃহত্তম আমদানিকারক ছিল ব্রাজিল যা সেই সময়ে পর্তুগিজ উপনিবেশ ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক আনা লুসিয়া আরাউজোর ব্রাজিলের সঙ্গে যোগ রয়েছে। তিনি বলেন, “বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দাস হিসাবে বন্দি মানুষকে প্রথমে ব্রাজিলে আনা হতো এবং তারপর সেখান থেকে অনেককে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ এবং বর্তমানের হাইতিতে নিয়ে যাওয়া হতো”।
বর্তমানে, আফ্রিকান বংশোদ্ভূতদের বৃহত্তম জনসংখ্যা রয়েছে ব্রাজিলে। এখানকার জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক মানুষের আফ্রিকার সঙ্গে যোগ রয়েছে। দাস হিসাবে আনা ৪০ লাখ ব্যক্তির মধ্যে অনেকেই নিজেদের দেশে ফিরে যেতে পেরেছিলেন।
এর সূচনা হয় ১৮৩৫ সালে, দাস বিদ্রোহের সঙ্গে। এই বিদ্রোহ দাস ব্যবসা রোধে বড় ভূমিকা পালন করেছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বিপুল সংখ্যক মানুষ যাদের এক সময় আফ্রিকা থেকে ক্রীতদাস হিসাবে বন্দি করে আনা হয়েছিল তারা দেশে ফিরে যান।
আনা লুসিয়া আরাউজো বলেন, “যারা আফ্রিকায় ফিরে গিয়েছিলেন তাদের জন্য বিষয়টা সহজ ছিল না। কারণ ততদিনে তাদের সংস্কৃতি বদলে গিয়েছে, ভাষা আলাদা, তাদের দেখতেও স্থানীয়দের থেকে অন্যরকম”।
“তবে তাদের নতুন দক্ষতা ছিল। অন্যান্য স্থানীয়দের তুলনায় এদের সামাজিক দিক থেকে উচ্চতর শ্রেণি বলে ভাবা হতো যা আবার বিষয়টাকে সংঘাতের দিকে পরিচালিত করে। প্রশ্ন উঠতে থাকে দাস ব্যবসায় কার কী ভূমিকা ছিল”।
এরপর ১৯৬০ সালের পহেলা অগাস্ট বেনিন ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীন হয়।
স্নায়ুযুদ্ধের সময়, বেনিনে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব ছিল। কিন্তু ১৯৯০-এর দশকে এই প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসে বেনিন। সেই সময় সেখানকার অর্থনীতি ভীষণভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
ড. আনা লুসিয়া আরাউজো ব্যাখ্যা করেছেন, বেনিনের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য সাংস্কৃতিক পর্যটনকে মাধ্যম করার সিদ্ধান্ত নেন। সে কথা মাথায় রেখেই সেখানে শুরু হয় ভুডু উৎসব, যা আজও পালিত হয়। প্রতি বছর জানুয়ারি মাসে এই উৎসব হয়।
আনা লুসিয়া আরাউজোর কথায়, “ভুডু উৎসব উদযাপনের পেছনে অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল আসল সমস্যা থেকে মানুষের দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়া। এই উৎসবে একদিকে যেমন যাদের পূর্বপুরুষ দাস ব্যবসার শিকার হয়েছিলেন তারা সামিল হন, আবার সেই ব্যক্তিরাও সামিল হন যাদের পূর্বপুরুষ এই ব্যবসার অংশ ছিলেন”।
বেনিন এই প্রকল্প থেকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছিল বটে, কিন্তু দাস ব্যবসা সেখানকার সমাজে যে গভীর ফাটল তৈরি করেছিল তা পুরোপুরি পূরণ করতে পারেনি।
আনা লুসিয়া আরাউজো বলেন, “আজও অনেক পরিবার ও সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা অব্যাহত রয়েছে। যারা বেনিনে ফিরে আসছেন তাদের মধ্যে দাহোমি রাজপরিবারের বংশধর রয়েছেন, যারা একসময় দাস ব্যবসার পৃষ্ঠপোষক ছিল, আবার সেই মানুষও রয়েছেন যাদের পূর্বপুরুষরা এর শিকার হন করেছিলেন”।
এই ঐতিহাসিক বিভাজন দূর করার জন্য, বেনিন আফ্রিকান বংশোদ্ভূত সুপরিচিত ব্যক্তিত্বদের আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। এই তালিকায় অর্থনীতিবিদ ড. লেনার্ড ওয়ানচেকনের মতো ব্যক্তিত্বও রয়েছেন।
নতুন সুযোগের যুগ
ড. লেনার্ড ওয়ানচেকন বেনিনের ‘আফ্রিকান স্কুল অফ ইকোনমিক্স’-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান। একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক অধ্যাপক তিনি। তার মতে বেনিনে একটা নতুন যুগের সূচনা হতে চলেছে যা সুযোগ ও সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ।
তার কথায়, “আমার জন্ম মধ্য বেনিনের একটা ছোট গ্রামে যেখানে মাত্র ২৫০ জন মানুষ বাস করতেন। আমি গর্বিত যে আমি সেখানে জন্মেছি”।
“আমার গ্রামের চারপাশে নদী ও পুকুর ছিল। বেনিনে পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। এখানে অনেক ঐতিহাসিক স্মৃতিসৌধ ও জাদুঘর রয়েছে”।
বেনিন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ এমন এক দেশ যেখানে পর্যটকদের দেখার মতো অনেক কিছু রয়েছে, যেমন যাদুঘর, স্মৃতিসৌধ, ইউরোপীয় দুর্গ এবং দাস ব্যবসার সাথে সম্পর্কিত রাজকীয় প্রাসাদ।
তবে নিরাপত্তার কারণে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক দেশই তাদের নাগরিকদের বেনিন সফরে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।
ড. লেনার্ড ওয়ানচেকন অবশ্য বলেছেন, “এতে কিছুটা তো বাড়াবাড়ি রয়েছে। খবরে যা দেখা যায় তার চেয়ে অনেকটা নিরাপদ বেনিন। এটা খুবই আকর্ষণীয় একটা দেশ”।
তিনি বলেন, “এখানে পাঁচটা সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে, কিন্তু কোনো রক্তপাত হয়নি। অন্যদিকে দেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। আমার গ্রামের ৪০ শিক্ষার্থী পড়ুয়া স্কুলে যেত, যার মধ্যে ১৪ জন আজ পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছে”।
শিক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও বেনিনের অর্থনীতি এখনো দুর্বল। ব্যবসার জন্য তাদের প্রতিবেশী দেশ নাইজেরিয়ার উপর নির্ভর করতে হয়। আফ্রিকার বৃহত্তম অর্থনীতি নাইজেরিয়া।
ড. লেনার্ড ওয়ানচেকনের মতে শুধু পর্যটনের উপর নির্ভর করে বেনিনের অর্থনৈতিক উন্নতি সম্ভব নয়। এর জন্য এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে মিলে কাজ করা দরকার।
ড. লেনার্ড ওয়ানচেকন জানিয়েছেন যে বেনিনে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ না থাকলেও এখানে কৃষি শিল্পে প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। বেনিনের পর্যটনের পাশাপাশি বেসরকারি শিল্পের দিকেও মনোনিবেশ করা দরকার। বিশেষত শিক্ষিত ব্যক্তিদের উৎসাহ দেওয়া দরকার। ভবিষ্যতের কথা ভেবে বেনিন অভিবাসীদের সমর্থন পাওয়ারও চেষ্টা করছে।
উন্নয়নের পথে
চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং উদ্যোক্তা টনিয়া লুইস লির পূর্বপুরুষদের একসময় বেনিন থেকে দাস হিসাবে বন্দি করে আনা হয়েছিল। চলতি বছরের জুলাইয়ে টনিয়া লুইস লি এবং তার স্বামী তথা চলচ্চিত্র নির্মাতা স্পাইক লিকে যুক্তরাষ্ট্রে আফ্রিকান-আমেরিকান কমিউনিটির দূত হিসাবে নিয়োগ করে বেনিনের সরকার।
টনিয়া লুইস লির মতে, দাস ব্যবসা অত্যন্ত মর্মান্তিক ছিল তবে সেই ক্ষত নিরাময় করাও দরকার।
তার কথায়, “আমি আশা করি যে এই পরিকল্পনার মাধ্যমে নিজের গল্প বলার সুযোগ পাবে বেনিন। একদিকে যেমন তার অতীতের গল্প বলতে পারবে তেমনই বলতে পারবে ভবিষ্যতে কোন দিকে যেতে চায় এই দেশ। শত শত বছর আগে বাস্তুচ্যুত হওয়া ব্যক্তিদের এখন ঘরে ফেরার বিকল্প দিচ্ছে এই দেশ”।
“সেই (দাস ব্যবসা) মর্মান্তিক বিষয়ের শিকার এবং যারা তা বাস্তবায়নে ভূমিকা পালন করেছিল, দুই পক্ষকেই কাছে আনতে এই প্রয়াস যাতে পুরানো ক্ষত নিরাময় হয়। এর মাধ্যমে ইতিবাচক অনেক কিছুই হতে পারে”।
বিদেশে বসবাসকারী আফ্রিকান বংশোদ্ভূত ব্যক্তিদের নিজ দেশের সঙ্গে জোরার এই দায়িত্ব পেয়ে খুবই খুশি টনিয়া লুইস লি।
তিনি জানিয়েছেন এটা তার স্বামী স্পাইক লির কাছেও একটা সুযোগ। তার স্বামী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই বার্তা দিতে সক্ষম হবেন যে আফ্রিকায় শিকড় রয়েছে এমন ব্যক্তিদের জন্য ফেরার জায়গা তৈরি করছে বেনিন।
টনিয়া লুইস লি বলেন, এখন আফ্রিকায় তাদের একটা থাকার ঠিকানা থাকবে। বেনিনের উদ্যোগ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রে প্রচার করতে হবে। বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে তাকে।
টনিয়া লুইস লির কথায়, “দাস ব্যবসার সঙ্গে পুরোপুরি জড়িত ছিল বেনিন। সেই অতীতের ক্ষত এখন নিরাময় করতে চায় সেই দেশ। ভুক্তভোগী এবং দাস ব্যবসার সাথে জড়িত ব্যক্তি-দুই পক্ষের বংশধরদের মধ্যে পুনর্মিলন ঘটিয়ে সম্প্রীতি আনতে চায়”।
“আমি মনে করি বেনিনের জন্য এটা একটা বড় সুযোগ। তারা বলতে পারবে দাস ব্যবসার সঙ্গে এক সময় যুক্ত ছিল এই দেশ এবং এখন শত শত বছর পরে পুনর্মিলনের জন্য সে দেশ যে পদক্ষেপ নিচ্ছে তা বিশ্বকে মানবতার বার্তা দেয়”।
“আমি মনে করি এই উদ্যোগ সেই মর্মান্তিক ঘটনার ক্ষত নিরাময় করতে এবং সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে”।
টনিয়া লুইস লির পূর্বপুরুষদের কয়েক শতাব্দী আগে বেনিন থেকে দাস হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তার পরিবারের বেশ কয়েক প্রজন্ম এখন মার্কিন নাগরিক।
তিনি বলেছিলেন যে তার পূর্বপুরুষরা ১৭০০ এর দশক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। তবুও, তিনি খুশি যে আফ্রিকায় এখন এমন একটা জায়গা রয়েছে যাকে তিনি নিজের ‘বাড়ি’ বলতে পারেন।
তার আশা বেনিন তার রাষ্ট্রদূত হিসাবে তিনি তারই মতো মার্কিন, ল্যাটিন আমেরিকান এবং ক্যারিবিয়ানদের অনুপ্রাণিত করতে পারবেন যাতে তারা নিজেদের শিকড়ের সঙ্গে যোগ তৈরি করতে পারেন।
তিনি বলেন, “নিজের শিকড়ের সঙ্গে জুড়তে পেরে আমরা আনন্দিত হই”।
আফ্রিকান বংশোদ্ভূত অভিবাসীদের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করতে বেনিন যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তার অংশ হিসাবে ২০২৪ সালে সে দেশে গিয়েছিলেন টোনিয়া লুইস লি। সেই সময় আবেগপ্রবণ হয়ে পরেছিলেন তিনি।
সে বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি উল্লেখ করেছেন, “আমার জন্য খুবই কঠিন ছিল সেই অভিজ্ঞতা। মনে পড়েছে শতাব্দী আগে কীভাবে আমার পূর্বপুরুষদের আমাদেরই লোকেরা জোর করে দাস বানিয়ে আমেরিকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল”।
“এই সব ভেবে আমার ভেতরে অনেক দুঃখ এবং ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। সেখানে ফিরে আসা আফ্রিকান বংশোদ্ভূত অন্যান্য মানুষের সেই একই অনুভূতি হয়েছে বলে আমার মনে হয়”।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বেনিন কি সত্যিই অভিবাসীদের ফিরিয়ে আনতে পারবে?
একদিকে যেমন ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয়তাবাদী চিন্তাভাবনা প্রভাব বিস্তার করছে, তেমনই অনেকেই শিকড়ে খোঁজে যাওয়ারও সময় এসেছে।
টনিয়া লুইস লি বিশ্বাস করেন যে বেনিনের এই উদ্যোগ আফ্রিকান অভিবাসীদের জন্য অতীতের মর্মান্তিক ক্ষত নিরাময়ের একটা সুযোগ বয়ে আনতে পারে।
তিনি বলেন, “আমার পূর্বপুরুষদের জোর করে এখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, আর আজ আমি আমার পরিবারের সঙ্গে এখানে ফিরে এসেছি। আমি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক এবং একইসঙ্গে আফ্রিকানও। এই দুই পরিচয়কে একসঙ্গে নিয়ে আমি ভবিষ্যতের জন্য ভালো কিছু করার চেষ্টা করব”।
“বেনিন উপকূলে দাঁড়িয়ে আমি সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আমি ভাবছিলাম আমরা এই মর্মান্তিক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গিয়েও টিকে গেছি। আমরা সামনে এগিয়েছি এবং আজ এখানে আবার ফিরে এসেছি”।
“এটা আমাদের মধ্যে থাকা শক্তিকে অনুভব করতে সাহায্য করেছে। আমার মনে হয় আমার পূর্বপুরুষরা নিশ্চয়ই খুশি হয়েছেন,” বলেন টনিয়া লুইস লি।

ডিজিটাল ডেস্ক 
























