আওয়ামী লীগকে ইঙ্গিত করে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, ‘এমন কাজ করা উচিত নয়, ক্ষমতা চলে গেলে পালিয়ে যেতে হয়, আত্মগোপনে যেতে হয় কিংবা ভয়ংকর পরিণতির মুখোমুখি হতে হয়। এটা কাম্য নয়।’
শনিবার (২১ ডিসেম্বর) রাতে সিলেটের একটি অভিজাত হোটেলে সিলেটের হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মতবিনিময় সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।
সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি দাবি করি, যার দুস্কৃতিকারী তাদের ধরে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দেওয়া হোক।
মতবিনিময় সভায় বক্তারা দুই হাজারের ওপর নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করেন। এ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে জামায়াত আমির বলেন, ‘সবগুলো নির্যাতন কিন্তু ধর্মীয় কারণে হয়নি। আমি রাজনীতি করি এটা অপরাধ না। যে ধর্মের মানুষ হই না কেন এ দেশের নাগরিক হিসেবে আমার রাজনীতি করার অধিকার আছে।
কিন্তু রাজনীতির সঙ্গে যদি সন্ত্রাস করি, সন্ত্রাসের কারণে যদি আমার ওপর কিছু আসে এটাকে ঠিক ধর্মের সঙ্গে কিন্তু মেলানো যাবে না। আমরা সেগুলোকে পরখ করে যদি দেখি দেখব অনেকগুলোই রাজনৈতিক কারণে ঘটেছে।’যারা রাজনীতি করবেন তাদের আরো সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘রাজনীতি যারা করবেন তিনি যে দলেই হোন, যে ধর্মেরই হোন-তাকে সতর্ক হয়ে রাজনীতি করা উচিত। এমন কোনো কাজ করা উচিত নয়- আমি ক্ষমতা থেকে চলে গেলে হয় আমাকে পালিয়ে যেতে হবে, না হয় আমাকে আত্মগোপনে যেতে হবে, না হয় আমাকে একটা ভয়ংকর পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে।
এমন রাজনীতি আমাদের কারো কাম্য নয়।’
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এখনকার সরকার রাজনৈতিক সরকার না হওয়া সত্ত্বেও জনগণের সচেতনতার কারণে আমাদের সমাজে শান্তি আছে-সেটা আমি বলব, খারাপ না। যা আছে যথেষ্ট। কিন্তু আরো বহু সুযোগ রয়ে গেছে এটাকে সামনে আরো সুন্দর করার।’
এর আগে মতবিনিময় সভায় দেওয়া বক্তব্যে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘ধর্মতো চাপিয়ে দেওয়ার কোনো বিষয় নয়।
এটা ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের ব্যাপার। যারা চাপাচাপি করে তারা ধর্মের সেন্টিমেন্ট বুঝে না-সে যে ধর্মেরই হোক। এটা বিভিন্ন দেশে ঘটে, বিভিন্ন ধর্মের পক্ষ থেকে ঘটে। এ সবগুলোকে আমরা নিন্দা করি। চাপাচাপির কোনো জায়গা নেই। আমরা মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখব।’
মেজরিটি-মাইনোরিটি মানেন না জানিয়ে জামায়াতের আমির বলেন, ‘চব্বিশের ৫ আগস্টের পর আমরা সাফ বলেছি-আমরা মেজরিটি-মাইনোরিটি মানি না। এদেশের যারা নাগরিক তারা সবাই সমমর্যাদাবান গর্বিত নাগরিক।’
সমান অধিকারের ভিত্তিতে এদেশকে দেখতে চান, গড়ে তুলতে চান মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘এখন অনেকে এ কথা বলতে শুরু করেছেন। গতকাল (শুক্রবার) খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের লোকজন বলেছেন, আমরাও আর মাইনোরিটিতে কোনো পরিচয় দিতে চাই না।’
তিনি বলেন, ‘ছোট্ট একটা দেশ, এত ভাগ কিসের আবার। জাতীয় স্বার্থে আমরা সবাই এক। কারণ দেশ বাঁচলে আমিও বাঁচব, সবাই বাচবে। অশান্তি হলে সবাইকে তা ভোগ করতে হবে। আমরা একটা শান্তিপূর্ণ মানবিক বাংলাদেশ গড়তে চাই।’
কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান তা বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘আমরা এরকম একটা বাংলাদেশ দেখতে চাই যেখানে একজন নেতার নির্বাচিত হওয়ার আগে যে সম্পদ ছিল নির্বাচিত হওয়ার পর তা কমবে, বাড়বে না। কারণ তিনি জনসভা করতে গিয়ে শুধু সরকারি টাকায় পারবেন না, তার নিজের টাকাও তাকে খরচ করতে হবে। সরকারি দায়িত্বে নিয়োগ হওয়ার পর তিনি নিজের দিকে খেয়াল দিতে পারবেন না তখন জনগণের বোঝা তাকে বহন করতে হবে।’
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘কিন্তু এখন আমরা দেখি, প্রথমবার এমপি হওয়ার আগে কারো সম্পদ এক কোটি টাকা ছিল, পাঁচ বছর পর দ্বিতীয়বার তিনি তার স্টেটমেন্ট জমা দিচ্ছেন সংসদে, সেখানে তিনি বলছেন-এখন তিনি ২৬ কোটি টাকার মালিক। তৃতীয়বার তিনি আড়াইশ কোটি টাকার মালিক। এই নির্বাচিত হলেই কেবল লাভ করা যায়, আর বাকি মানুষের কোনো লাভ নাই। মারাত্মক লাভজনক ব্যবসা এই রাজনীতি।’
জামায়াতের ওপর প্রায়ই অভিযোগ বোমা নিক্ষেপ করা হয় দাবি করে তিনি বলেন, ‘মঈন-ফখর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় হঠাৎ এক বুদ্ধিজীবী হুংকার দিয়ে উঠলেন যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ৩০ হাজার একর জমি অবৈধভাবে দখল করেছেন। তখনকার সরকার সারা দেশে সার্কুলার পাঠিয়ে বলে দিলো-তন্ন তন্ন করে খুঁজে এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য। সব জায়গা থেকে রিপোর্ট দিয়েছিল-তারা এরকম কিছু খুঁজে পায়নি। এরকম আমাদের বিরুদ্ধে মাঝে মধ্যেই অভিযোগ বোমা নিক্ষেপ করা হয়। বোমা ফুটানো হয় অভিযোগের।’
তার দলের কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে সরাসরি তাকে জানানোর আহ্বান জানিয়ে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘আপনাদের সঙ্গেই তো আমরা বড় হয়েছি। আমাকে খুব সহজে পাওয়া যায়। আমার মোবাইলে কোনো ফিল্টার নেই। শুধু মানুষটাকে চিনলেই আমার হলো, অচেনা মানুষের ফোন নিরাপদ নয়-তাই ধরি না। আমার সঙ্গে একদম খোলা মনে কথা বলবেন। আমাদের কারো দ্বারা যদি এরকম কোনো অপরাধ হয়ে থাকে, যেখানে আপনাদের সম্পদের, ইজ্জতের ক্ষতি হয়েছে-আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি আপনার বিচার পাবেন। আমার হাত দিয়েই পাবেন-যদি আমি জীবিত থাকি।’
বিগত দূর্গাপূজায় সর্বাত্মক সহযোগিতার মনোভাব নিয়েছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দূর্গাপূজার সময় আমরা সারা দেশে বলে দিয়েছিলাম, যদি আপনারা আমাদের সহযোগিতা চান তাহলে সর্বাত্মক সহযোগিতা করব। আমি সারা দেশ থেকে এমন কোনো অভিযোগ পাইনি যে আমাদের সহযোগিতা চেয়ে পাননি কেউ। এটা হতে পারে-সহযোগিতা চাওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। কিন্তু যারা চেয়েছেন আমরা তাদের সহযোগিতা করেছি।’
তার দল চাঁদাবাজিতে নেই দাবি করে তিনি বলেন, ‘আগেও চাঁদাবাজি হয়েছে। এখন ফ্ল্যাগ পরিবর্তন হয়েছে। এখনও অনেকে চাঁদাবাজি করছেন। আমাদেরও তো দুইটা হাত আছে। আমরা পারতাম না চাইলে চাঁদাবাজি করতে? কিন্তু আমরা আমাদের লোকদের বলে দিয়েছি-এটা সাফ হারাম। আলাহামদুলিল্লাহ বাংলাদেশের কোথাও থেকে কোনো অভিযোগ আসেনি। সিলেটে যদি এরকম কোনো অভিযোগ দেন-আমি আপনাদের সামনে রেখে এর বিচার করব।’
আওয়ামী লীগের আমলে তার দল সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছে দাবি করে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘আপনারা আশা করি আমাদের সঙ্গে একমত হবেন, গত সরকারের হাতে আমরা ছিলাম সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত। আমাদের ১১ জন টপ লিডারকে খুন করা হয়েছে, জুডিশিয়াল কিলিং। আমাদের অসংখ্য সাথী নিহত হয়েছেন, পঙ্গু হয়েছেন। হাজার হাজার মামলা হয়েছে, লাখ লাখ লোক আমরা জেলে গিয়েছি। আমাদের সবগুলো অফিস, শুধু সিলেটের অফিস ছাড়া কেন্দ্রীয় অফিসসহ সারা বাংলাদেশের অফিস সাড়ে তের বছর একটানা সিলগালা ছিল। আমরা এক সেকেন্ডের জন্য অফিসে ঢুকতে পারিনি। আমি আমার কেন্দ্রীয় অফিসে ঢুকতে পারিনি। আমাদের দলকে নির্বাচন কমিশন থেকে অনিবন্ধিত করা হয়েছে। নিবন্ধন কেড়ে নেওয়া হয়েছে। শেষমুহূর্তে এসে সরকার আমাদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।’
এতবড় চাপ কোনো দলের ওপর দিয়ে যায়নি মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘মানুষ কারো বেশি মারা যেতে পারে সেটা আমি অস্বীকার করবো না। সে হিসাব হয়তো সবার কাছে আছে। কিন্তু সবমিলিয়ে এত চাপ আর কোনো দলের ছিল না। কিন্তু ৫ তারিখে আমরা সারা দেশে আমাদের কর্মীদের বলেছিলাম-এখন দ্রুত কিছু কাজ করে ফেলতে হবে। প্রথমত সমস্ত মানুষ যাতে নিরাপদ থাকে-রাস্তায় রাস্তায় নেমে যাও, ঘরে ঘরে যাও, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকেদের কাছে যাও, তাদের সঙ্গে বসো। তাদের সাহস যোগাও। বলো আমরা পাশে আছি। কোনো দুস্কৃতিকারীকে আমরা প্রশ্রয় দেবো না। আমরা আমাদের ভলেন্টিয়াদের বলেছি, সবধর্মের প্রতিষ্ঠান, মসজিদসহ পাহারা দাও। কোনো জায়গায় কি হয় বলা যায় না। দিন রাত, খেয়ে না খেয়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে শুকিয়ে টানা ১৫ দিন আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা বিভিন্ন জায়গায় পাহারা দিয়েছেন। এরপর আমরা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজনের সঙ্গ আবার বসেছি। বসে আশ্বস্ত করেছি। আবার বসেছি।’