নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন সংসদ নির্বাচনের আইন সংস্কারের যেসব সুপারিশ করেছে তার অন্যতম হচ্ছে, একাধিক আসনে কোনো ব্যক্তির প্রার্থী হওয়ার বিধান বাতিল করা। কমিশনের পক্ষে বলা হচ্ছে, মূলত দুটি কারণে এই সুপারিশ করা হয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে উপনির্বাচনের ব্যয় কমানো। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে প্রভাবশালী কোনো প্রার্থীকে একাধিক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না দিয়ে সংশ্লিষ্ট আসনের প্রকৃত প্রার্থীদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করা।
২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ড. এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন সংসদ নির্বাচনে এক ব্যক্তির দুই বা ততোধিক আসনে প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি নিরুৎসাহ করার চেষ্টা করে।
অতীতে দেখা গেছে, অনেক প্রার্থী একের অধিক, এমনকি সর্বোচ্চ পাঁচটি আসনে প্রার্থী হয়েছেন। কোনো প্রার্থী একাধিক আসনে নির্বাচিত হলে পরবর্তী সময়ে সংবিধানের ৭১ অনুচ্ছেদের (২)(ক) দফার বিধান অনুযায়ী তাঁকে একটি মাত্র আসন রেখে বাকি সব আসন ছেড়ে দিতে হয়। তিনি ছেড়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শূন্য ঘোষিত আসনগুলোতে পুনর্নির্বাচন করতে হয়।
এসব পুনর্নির্বাচনে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হয় এবং প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়। এই প্রেক্ষাপটে সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সর্বোচ্চ তিনটি আসনে প্রার্থিতার সুযোগ রাখাই যুক্তিযুক্ত এবং পুনর্নির্বাচনের সম্ভাব্য ব্যয়ের একটি অংশ এরূপ প্রার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা সমীচীন।
সে সময় নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে প্রস্তাব রাখে, ‘কোনো ব্যক্তি একই সময়ে তিনটির অধিক নির্বাচনী এলাকার জন্য প্রার্থী হতে পারবেন না। একাধিক আসনে মনোনয়নপত্র দাখিল করলে অতিরিক্ত প্রতিটি আসনের জন্য পাঁচ লাখ টাকা জমা দিতে হবে এবং জয়লাভ করে এরূপ আসন ছেড়ে দিলে এই জামানত বাজেয়াপ্ত করা হবে।’
নির্বাচন কমিশনের সর্বোচ্চ তিনটি আসনের প্রস্তাব সে সময় আইনে পরিণত হয়। তবে অতিরিক্ত প্রতিটি আসনের জন্য পাঁচ লাখ টাকা জামানত এবং নির্বাচনে জয়ের পর সেই আসন ছেড়ে দিলে ওই জামানত বাজেয়াপ্ত করার প্রস্তাবটি গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
এদিকে সংসদ নির্বাচনের আইন বা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে এক ব্যক্তির একাধিক আসনে প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি নির্দিষ্ট করে দেওয়া হলেও সংবিধানে এ বিষয়ে কোনো সংশোধনী আনা হয়নি।
সংবিধানের ৭১ অনুচ্ছেদের (১) দফায় বলা আছে, ‘কোনো ব্যক্তি একই সময়ে দুই বা ততোধিক নির্বাচনী এলাকার সংসদ সদস্য হইবেন না।’ (২) দফায় বলা আছে, ‘কোনো ব্যক্তির একই সময়ে দুই বা ততোধিক নির্বাচনী এলাকা হইতে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় এই অনুচ্ছেদের (১) দফায় বর্ণিত কোনো কিছুই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করিবে না, তবে তিনি যদি একাধিক নির্বাচনী এলাকা হইতে নির্বাচিত হন তাহা হইলে (ক) তাঁহার সর্বশেষ নির্বাচনের ৩০ দিনের মধ্যে তিনি কোন নির্বাচনী এলাকার প্রতিনিধিত্ব করিতে ইচ্ছুক, তাহা জ্ঞাপন করিয়া নির্বাচন কমিশনকে একটি স্বাক্ষরযুক্ত ঘোষণা প্রদান করিবেন এবং তিনি অন্য যেসব নির্বাচনী এলাকা হইতে নির্বাচিত হইয়াছিলেন, অতঃপর সেই সব এলাকার আসনসমূহ শূন্য হইবে।’
০১৮ সালের জাতীয় সংসদে এ বিষয়ে সংশোধনী প্রস্তাব দেওয়া হয়। স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য রুস্তম আলী এই সংশোধনীর প্রস্তাবে উল্লেখ করেন, ‘সংবিধানে বলা আছে, একই সময়ে এক ব্যক্তি দুই বা ততোধিক নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রার্থী হতে পারবেন। অর্থাৎ একই ব্যক্তি একই সময়ে ১০০ বা ২০০ যে কয়টি আসন থেকে ইচ্ছা নির্বাচন করতে পারবেন।’
আবার গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) বলা আছে, ‘একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ তিনটি নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রার্থী হতে পারবেন। এতে সংবিধান ও আরপিওর বিধানে সাংঘর্ষিক অবস্থা তৈরি হয়েছে। এ জন্য সংবিধানের ৭১ অনুচ্ছেদটি সংশোধন প্রয়োজন।’ সে সময় এই প্রস্তাব পরীক্ষা করে বিবেচনার জন্য আইন মন্ত্রণালয়কে বলা হলেও পরে আর অগ্রগতি হয়নি।
যাঁরা সর্বোচ্চ পাঁচটি আসনে নির্বাচিত হয়েছিলেন : ১৯৯১ সালের পঞ্চম থেকে শুরু করে ২০০১ সালের অষ্টম পর্যন্ত তিনটি সংসদ নির্বাচনেই বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্রতিবারই পাঁচটি আসনে প্রার্থী হয়েছেন এবং সব কটি আসনে তিনি জয়লাভ করেন।
২০০৮ সালে সর্বোচ্চ তিনটি আসনের বিধান করলে খালেদা জিয়া নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনটি আসনে প্রার্থী হয়ে সব কটিতেই জয়ী হন। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পঞ্চম ও সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পাঁচটিতেই জয়ী হন। ২০০৮ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনেও এরশাদ তিনটি আসনে নির্বাচন করে তিনটিতেই জয়ী হন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে একটিতে জয়ী হন।
তিনি সপ্তম সংসদ নির্বাচনে তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনটিতেই জয়ী হন। অষ্টম সংসদ নির্বাচনে পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হন চারটি আসনে এবং ২০০৮ সালে তিনটি আসনে নির্বাচন করে জয়ী হন তিনটি আসনেই। এ হিসাবে পাঁচটি আসনে জয়ী হওয়ার রেকর্ড শেখ হাসিনা অর্জন করতে পারেননি।