গ্রীষ্মের প্রচণ্ড খরা। ঠাটা পড়া রোদে কাকপক্ষীও আকাশে উড়েনা। কিন্তু জীবিকার তাগিদে জানপোড়া গরম উপেক্ষা করে বৃক্ষ নার্সারিতে কাজ করছে একদল নারী শ্রমিক। ওদের নাম দুখী, সুখী, শ্রাবণী, জমিলা, সাবিনা, খোদেজা আর বাসন্তি।
দুখীর বাড়ি মধুপুর উপজেলার হাসনৈ আর সুখীর বাড়ি আড়ালিয়া গ্রামে। বাকি পাঁচ জনের ঠিকানা একই উপজেলার গোলাবাড়ী, কালামাঝি, পচিশা ও গোপদ গ্রামে। মধুপুর-গোপালপুর সড়কের কালামাঝি এতিমখানার ১০০ গজ পূর্বে খোকন নার্সারিতে কয়েক দিন ধরেই কাজ করছে ওরা। প্রতিদিন সকাল ৮টায় কাজে আসে। বিকাল ৫টায় ছুটি। দুপুরে এক ঘণ্টা বিরতি। বাড়ি থেকে পুটলিতে আনা পান্তা-পেঁয়াজে সারে দুপুরের আহার। পান্তার গুণাগুণ নিয়ে জমিলা বেগম জানায়, এ খাবার খেলে শরীর ঠান্ডা থাকে। তখন রোদে কাজ করতে স্বস্তি পাই। তারা জানান, আট ঘণ্টা খাটাখাটনির পর দৈনিক মজুরি ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। প্রচণ্ড রোদ থেকে হালকা ছায়ার জন্য রঙিন কাপড়ে বানানো ছাতার ব্যবস্থা করেছে মহাজন। সেই ছাতার ডান্ডির গোড়ালিতে লোহার বর্শা লাগানো। যাতে পালা করে নিড়ানি দেওয়ার সময় ছাতা কায়দামতো সামনে গেড়ে নেওয়া যায়। খরায় জমিনের মাটি একদম তপ্ত। সেই তাপ থেকে বাঁচার জন্য দুই পায়ে জড়িয়েছে কলার খোলে তৈরি জুতো।
দুখীর (৫৯) বয়স যখন তিন বছর তখন বাবা ছদর আলী মারা যান। মা রওশন অন্যের বাড়ি ঝিয়ের কাজ করত। অভাবের সংসারে দুমুঠো ভাত তুলে দিতে না পারায় ১০ বছর বয়সেই দুখীর বিয়ে হয়। এক বাচ্চার মা হওয়ার পরই দুখীর কপাল ভাঙে। যৌতুকের জন্য স্বামী তালাক দেয়। এরপর বাপের ভিটায় ফিরে পেটের তাগিদে দিনমজুরি শুরু। দুখী জানায়, জনম ধরেই অভাবঅনটন আর বঞ্চনা বয়ে বেড়াতে বেড়াতে দুঃখকে সে আপন করে নিয়েছে। বয়স বাড়াতে কাবু শরীরে ধান কাটা, মলা বা রোপা লাগানোর কাজ পারেন না। আলু তোলা, সবজি বা কলা বাগানে নিড়ানির কাজ করেন সারা বছর। এতে যে মজুরি মিলে তা দিয়ে কোনোভাবে পেট চলে। সুখী বেগমের জীবনের ইতিহাসও দুখীর মতোই একই অধ্যায়ের অন্তর্গত। বাবা-মা আদর করে নাম রেখেছিলেন সুখী। কিন্তু সুখ পাখির নাগাল কখনোই মিলেনি। এ বয়সে হাড়ভাঙা খাটুনি না খাটলে ভাত জোটে না। তাই সারা বছর দিনমজুরি করেই পেট চলে তার।
পুরুষ শ্রমিকের মজুরি যেখানে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা। সেখানে নারী শ্রমিকের মজুরি মাত্র ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মধুপুর উপজেলায় আনারস, কলা, বৃক্ষ নার্সারি এবং সবজি বাগানে কাজ করে এমন নারী শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার। আশপাশের উপজেলা থেকেও অনেক নারী শ্রমিক এখানে এসে কাজ করে থাকেন। এদের একটাই সাধারণ অভিযোগ মজুরি বড্ড কম।
আনারস ও লেবুর বাণিজ্যিক খামারি রহমত আলী জানান, তিনি খুব কমসংখ্যক নারী শ্রমিক খামারে রাখেন। মজুরি সামান্য কমবেশি করেন। তবে অধিকাংশ গৃহস্থ ও খামারি নারী শ্রমিকদের নানাভাবে কম মজুরি দিয়ে থাকেন। টাঙ্গাইল জেলা দিনমজুর সমিতির সভাপতি হাসান মিয়া জানান, নারী শ্রমিকদের বড় অংশ স্বামী পরিত্যক্তা, বিধবা অথবা ছিন্নমূল। গড় বয়স পঞ্চাশের বেশি। সামান্য পেটভাতের সংস্থান হলেই তারা কাজ করতে রাজি হন। এ সুযোগ নিয়ে থাকেন বড় গৃহস্থরা। ঠকলেও এরা কখনো অভিযোগ দিতে চায় না। ফলে অবস্থাপন্ন গৃহস্থ, কৃষি খামারি এবং মহাজনরা তাদের পুরুষদের তুলনায় কম মজুরি দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে।
আরো পড়ুন……

 Reporter Name
																Reporter Name								 

























