তবে সম্প্রতি ৬৩ জনের একটি জনবল কাঠামো অনুমোদনের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। জনপ্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর গণঅভ্যুত্থান অধিদপ্তরের কার্যক্রম শুরু হবে। তবে এর আগে নীতিমালা প্রণয়ন করে শহীদ পরিবার ও আহতদের সহায়তা দিতে তৎপরতা চলছে।
এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক ই আজম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অধিদপ্তর গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। এ লক্ষ্যে মন্ত্রণালয় নীতিমালা তৈরি করছে। চলতি মাসে নীতিমালা অনুমোদন হতে পারে। সরকার স্থান নির্বাচন করার পর সেখানে অধিদপ্তরের কার্যক্রম শুরু হবে।’
এদিকে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, খসড়ার নামকরণ করা হয়েছে ‘২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে সংগঠিত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবারের সদস্য ও আহতদের সহায়তা বা পুনর্বাসনের লক্ষ্যে প্রণীত নীতিমালা’। এটি এখনও পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের কর্তৃপক্ষের মতামতের ভিত্তিতে শিগগির এটি গেজেট আকারে প্রকাশের জন্য চূড়ান্ত করা হবে।
গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে নিহত ও আহতের বিষয়ে খসড়ায় বলা হয়েছে, ‘নিহতদের অনেকে ছিলেন সুবিধাবঞ্চিত এবং আর্থসামাজিক মানদণ্ডে নিম্নমধ্যবিত্ত বা হতদরিদ্র শ্রেণির। অনেকে ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাদের ক্ষতি অপূরণীয়।
অন্যদিকে, জীবিত অনেকের অবস্থা জীবন্মৃতের ন্যায়। গুরুতর আহত অনেকে আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন না। তাদের জরুরি ভিত্তিতে পুনর্বাসন প্রয়োজন। যে অকুতোভয় ছাত্র-জনতা দেশকে স্বৈরাচারের কবল থেকে মুক্ত করেছেন, তাদের সে আত্মত্যাগের সামান্য প্রতিদান রাষ্ট্র দিতে পারে। যারা প্রাণ উৎসর্গ করেছেন, তাদের পরিবার বা আন্দোলনে গুরুতর আহত হয়েছেন, তাদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা, এ-সংক্রান্ত ব্যয় এবং কর্মসংস্থানের দায়িত্ব সরকার গ্রহণ করতে বদ্ধপরিকর।’ খসড়ায় গণঅভ্যুত্থানে ‘ঝরে গেছে আট শতাধিক প্রাণ এবং আহত হয়েছেন হাজার হাজার ছাত্র-জনতা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
খসড়া অনুযায়ী, চার ক্যাটেগরিতে অভ্যুত্থানে আহতরা আর্থিক সহায়তা পাবেন। এর মধ্যে ‘এ’ ক্যাটেগরিতে আওতাভুক্তদের ‘আজীবন সাহায্যের আওতায়’ আনা হবে। এতে উভয় হাত/পাবিহীন, দৃষ্টিহীন, সম্পূর্ণভাবে মানসিক বিকারগ্রস্ত এবং কাজ করতে অক্ষম বা অনুরূপ আহত ব্যক্তিরা অন্তর্ভুক্ত হবেন।
‘বি’ ক্যাটেগরিতে অন্তর্ভুক্তদের দীর্ঘদিন ‘সাহায্য’ দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে এক হাত/পাবিহীন, আংশিক দৃষ্টিহীন, মস্তিষ্কে গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত বা অনুরূপ আহত ব্যক্তিরা এই ক্যাটেগরিতে স্থান পাবেন। ‘সি’ ক্যাটেগরিতে শ্রবণ/দৃষ্টিশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত, গুলিতে আহত বা অনুরূপ আহত ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এ ক্ষেত্রে স্থান পাবেন, যারা এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, সুস্থ হতে আরও চিকিৎসার প্রয়োজন এবং স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে সক্ষম হবেন। আর ‘ডি’ ক্যাটাগরিতে সাধারণ আহতদের (সুস্থ হয়ে বাড়ি গেছেন এবং স্বাভাবিক কাজকর্ম করছেন) স্থান দেওয়া হয়েছে।
সংজ্ঞা
নীতিমালায় বিষয়ভিত্তিক সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে। গণঅভ্যুত্থান বলতে ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং জুলাই-আগস্ট ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে বোঝাবে’। একইভাবে ‘শহীদ’-এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে ‘যিনি ২০২৪ সনের ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করে প্রতিপক্ষের আক্রমণে মারা গেছেন অথবা গুরুতর আহত হয়ে পরে মারা গেছেন।’ আহতের বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘গণঅভ্যুত্থান চলাকালে তৎকালীন সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অথবা তার রাজনৈতিক অঙ্গ সংগঠনের সশস্ত্র ক্যাডার দ্বারা আহত হয়েছেন এরূপ ব্যক্তি, যার শরীরের এক বা একাধিক অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’ পুনর্বাসনের বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘গণঅভ্যুত্থান চলাকালে শহীদ হয়েছেন এমন ব্যক্তির পরিবারের এক বা একাধিক সদস্য অথবা আহত ব্যক্তির কর্মসংস্থানের জন্য সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি এবং তাঁর দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক উপার্জনমুখী কাজের জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান, এককালীন/মাসিক অনুদান প্রদান, কর্মসংস্থান বা প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে পুনর্বাসনের ব্যবস্থাকে বোঝাবে।’
কমিটি
নীতিমালায় শহীদ পরিবারের সদস্য ও আহতদের পুনর্বাসনের জন্য পৃথক দুটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সভাপতি করে ১৮ সদস্যের কমিটিতে মাঠ প্রশাসনের শীর্ষ সব পর্যায়ের কর্মকর্তাকে যুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া একইভাবে জেলা প্রশাসককে সভাপতি করে ১৫ সদস্যের, বিভাগীয় কমিশনারকে সভাপতি করে ১৩ সদস্যের এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টাকে ‘উপদেষ্টা’ করে ২৩ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটির গঠনের জন্য বলা হয়েছে খসড়ায়। এই কমিটিগুলো ‘শহীদ’, ‘শহীদ পরিবার’ এবং আহত ও আহতদের পরিবারসহ এ-সংক্রান্ত বিষয়কে তালিকা প্রণয়ন, মতামত প্রদানসহ নানা বিষয়ে কার্য সম্পাদন করবে।
পুনর্বাসন ও আর্থিক সহায়তা পাওয়ার যোগ্যতা
এ প্রসঙ্গে খসড়ায় বলা হয়েছে ‘উপযুক্ত কাগজপত্র দাখিল সাপেক্ষে চিকিৎসা সুবিধা প্রদানের যোগ্য হবেন।’ তবে ‘শুধুমাত্র আহত হিসেবে তালিকাভুক্তি আর্থিক সহায়তা পাওয়ার নিশ্চয়তা প্রদান করবে না’। পাশাপাশি ‘তালিকায় অন্তর্ভুক্ত আহত ব্যক্তির চিকিৎসা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য ডেটাবেজে অব্যাহতভাবে হালনাগাদ করা হবে।’
সহায়তার পরিমাণ
খসড়ায় বলা হয়েছে ‘শহীদ হয়েছেন এমন ব্যক্তির পরিবার/সদস্যগণ সরকার নির্ধারিত এককালীন/মাসিক অনুদান প্রাপ্য হবেন। শহীদ ব্যক্তির আর্থসামজিক অবস্থা, বয়স, তাঁর ওপর পরিবারের নির্ভরশীলতা পর্যালোচনা করে গ্রহণযোগ্য এককালীন/মাসিক অনুদান নির্ধারণ করা হবে।’ সরকারি অনুদান বণ্টনের ক্ষেত্রে উত্তরাধিকার আইন প্রযোজ্য হবে। খসড়ায় মিথ্যা ও ভুল তথ্য দিয়ে সহায়তা নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি পাওনা আদায় আইন ১৯৯৩ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া অভিযোগ ও প্রতিকারের বিষয়েও খসড়ায় অভিযোগ দায়ের ও আপিলের বিধান রাখা হয়েছে।
অসন্তোষ
এদিকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলকে (জামুকা) অধিদপ্তর করার কার্যক্রম না থাকায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। তারা অনেকে বলছেন, গণঅভ্যুত্থান অধিদপ্তর হচ্ছে, এটি সরকারের নীতির বিষয়। তবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায় জামুকাকেও অধিদপ্তর করতে হবে। অধিদপ্তর না হওয়ায় একই পদে তাদের দীর্ঘদিন কাজ করতে হচ্ছে বলেও দাবি তাদের। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ নিয়ে নানামুখী আলোচনা হলেও পরিস্থিতির কারণে কেউ প্রকাশ্যে আসছেন না। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে জামুকার ৩১তম সভায় এ মন্ত্রণালয়ের আওতায় অধিদপ্তর গঠনের জন্য আইনের খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন করা হয়েছিল। পরে দফায় দফায় এ নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ইশরাত চৌধুরী বলেন, আপাতত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক অধিদপ্তর গঠনের বিষয়টি সরকারের আলোচনায় নেই।