প্রায় ৩৩ বছর আগের কথা- বরিশালের তেঁতুলিয়া নদীতে ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে যায় একটি জাপানি জাহাজ ‘এমবি মোস্তাবি’। তারপর দফায় দফায় চেষ্টা করেও সেই জাহাজ উদ্ধার হয়নি। দাদা-নানা কিংবা এলাকার মুরুব্বিদের কাছে এই জাহাজ নিয়ে নানা শোনা যেত বিভিন্ন গল্প কাহিনী।
সেই থেকে জাহাজটি ঘিরে নতুন প্রজন্মের কৌতুহল জন্মে। এবার রহস্য সৃষ্টি হওয়া সেই জাহাজটি উদ্ধারের খবর পাওয়া গেছে।
উদ্ধারকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, তেঁতুলিয়া নদীতে ৩৩ বছর আগে পণ্যবাহী ওই জাহাজ ডুবে গিয়েছিল। দীর্ঘ সময়ে নদীর তলদেশে জাহাজ ডুবে যাওয়া স্থানে পলি জমে চর পড়ে যায়। এক যুগের বেশি সময় ধরে চেষ্টার পর সেই চর খনন করে প্রায় ৭০ ফুট নিচ থেকে সেটি উদ্ধার করা হয়েছে।
এর আগে একাধিক উদ্ধারকারী দল জাহাজটি তোলার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। সবশেষ উদ্ধারে নিলামের জন্য ২০০৫ সালে দরপত্র ডাকে বিআইডব্লিউটিএ। সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে ২০ লাখ টাকায় নিলাম পায় খুলনার ‘অগ্রণী ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট’ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির মালিক আনসার উদ্দিন মারা যাওয়ার আগে কাজটি কিনে নেন সাব ঠিকাদার বরিশালের বাসিন্দা মো. ইউসুফ মিয়া।
ইউসুফ মিয়া বলেন, ২০১২ সাল থেকে কয়েক দফা জাহাজটি তোলার চেষ্টা করলেও উদ্ধার করতে পারিনি। চার মাস আগে আবার প্রায় পাঁচ একর জমি ও ৪৮ ফুট চর খনন করে এটি তোলা হয়। উদ্ধারকাজে ব্যবহার করা হয় তিনটি শক্তিশালী বিকে বার্জ (নদী বা সমুদ্রের অগভীর পানিতে পণ্য পরিবহনে ব্যবহৃত হয়), বিশেষ ধরনের ক্রেন, ডুবুরি ও আধুনিক প্রযুক্তি। শ্রমিক ছিলেন শতাধিক। উদ্ধার জাহাজটির দৈর্ঘ্য ১৮০ ফুট, প্রস্থ ১৪ ফুট এবং উচ্চতা ১৭ ফুট। দামি যন্ত্রাংশের মধ্যে আছে ইঞ্জিনসহ অন্যান্য মালামাল।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এক সময় তেঁতুলিয়া নদীর ওই অংশ দিয়ে বড় বড় জাহাজ চলাচল করতো। নদীও উত্তাল ছিল। ১৯৯২ সালে জাহাজটি সেখানে ডুবে যায়। এরপর সরকারি-বেসরকারিভাবে উদ্ধারের চেষ্টা চলে। কিন্তু কোনোভাবেই উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তবে জাহাজে থাকা কিছু বৈদ্যুতিক মালামাল উদ্ধার করা হয়েছিল আগেই। এরই মধ্যে ডুবে যাওয়া জাহাজের ওই অংশে চর পড়তে শুরু করে। ২০১২ সালের দিকে চর দৃশ্যমান হয়। এরপর থেকে সেখান দিয়ে নৌযান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পাশাপাশি জোয়ার-ভাটা বাধাগ্রস্ত হয়ে পলি জমতে থাকে। সেইসঙ্গে চর জেগে ওঠে। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ১০ একরের বেশি জমিজুড়ে চর জাগে। সেগুলোতে মানুষের বসতি গড়ে ওঠে। প্রতিদিন বসতির সংখ্যা বাড়ছে। পাশাপাশি সেখানকার বাসিন্দারা চরে চাষাবাদও শুরু করেন। ইতিমধ্যে পুরো জাহাজটি দৃশ্যমান হয়। পরে খণ্ড খণ্ড কেটে উদ্ধার করা হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. আখতার হোসাইন বলেন, ছোট বেলায় দাদার মুখে জাহাজটির ব্যাপারে অনেক কথা শুনেছি। অনেকেই বলতো জাহাজটি কোনোদিন উদ্ধার করা সম্ভব হবে না। যেহেতু বাড়ির কাছাকাছি এলাকাতেই এটা ডুবে আছে, দেখার ইচ্ছে হতো। ছোটবেলা থেকেই দেখছি এটা তুলতে অনেকবার চেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু সফল হয়নি। শেষ পর্যন্ত এটি তোলা হয়েছে। যা দেখতে এলাকাবাসীসহ আশপাশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছুটে আসেন অনেকেই।
উপজেলার চর গোপালপুর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য (মেম্বার) মো. মাসুদ বলেন, আমাদের ধারণা ছিল, কোনোদিন তোলা সম্ভব হবে না। কিন্তু যারা কাজ করেছেন তাদের আত্মবিশ্বাস ছিল। এক যুগ ধরে শ্রমিকরা ওই গ্রামে বাস করায় সেখানের বাসিন্দার মতো হয়ে গেছেন।দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে নদীতে ডুবে যাওয়া জাহাজ উত্তোলনের কাজ করছেন খুলনার বাসিন্দা আব্দুল মান্নান মৃধা। তিনি বলেন, এক যুগের বেশি সময় ধরে খননকাজ চালিয়ে কেটে কেটে জাহাজটি তোলা হয়। এই কাজে প্রতিদিন কমপক্ষে ৪০ জন শ্রমিক কাজ করেছেন। কয়েক দশক ধরে নদীর তলদেশে থাকার পরও জাহাজের রং প্রায় অক্ষুণ্ণ আছে। কাঠামোর প্লেটগুলো এখনও মজবুত আছে। আমার কাছে জাহাজের দামি জিনিসের মধ্যে রয়েছে মেশিন। যার মূল্য ১৫ কোটি টাকা। কিন্তু এখন ভাঙারি হিসেবে ২৫ লাখ টাকায় বিক্রি করা সম্ভব হবে।
মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রিয়াজুর রহমান বলেন, যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া মেনে জাহাজটি উত্তোলন করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এখন এটি কেটে টুকরো টুকরো করে বিক্রি করা হচ্ছে।
বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা যায়, ব্যক্তি মালিকানাধীন কোনও নৌযান ডুবে গেলে তা উদ্ধারে তিনবার চিঠি দেয় সংস্থাটি। এরপর কোনও সাড়া না পেলে নৌযানটিকে নিলামে তোলার বিধান আছে।
বিআইডব্লিউটিএর সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগের বরিশালের যুগ্ম পরিচালক আবদুল্লাহ আল বাকী বলেন, মেহেন্দীগঞ্জে ডুবে যাওয়া নৌযানটি উদ্ধার করা হয়েছে।