ময়মনসিংহ , রবিবার, ২৭ জুলাই ২০২৫, ১২ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
নোটিশ :
প্রতিটি জেলা- উপজেলায় একজন করে ভিডিও প্রতিনিধি আবশ্যক। যোগাযোগঃ- Email- matiomanuss@gmail.com. Mobile No- 017-11684104, 013-03300539.

ঐকমত্য কমিশন সমঝোতায় পৌঁছাতে জোর চেষ্টা চালাচ্ছে

  • অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট সময় ১০:৫৫:১২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৬ জুলাই ২০২৫
  • ১৬ বার পড়া হয়েছে

রাষ্ট্র সংস্কারের প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছাতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। যে কারণে দলগুলোর মতামতের পর প্রস্তাবে প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে, নতুন প্রস্তাবের মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। সমঝোতায় পৌঁছাতে বাতিল করা হয়েছে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের প্রস্তাব। বিকল্প হিসেবে সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে সাংবিধানিক কমিটি গঠনের নতুন প্রস্তাব করা হয়।
তাতেও সমঝোতা না হওয়ায় সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে বাছাই কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়। তবে নির্বাচন কমিশন ছাড়া অন্য প্রতিষ্ঠানে এই কমিটি গঠনে আপত্তি রয়েছে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর। ফলে এ নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর সম্ভাবনা কম। একইভাবে দলগুলোর পরস্পরবিরোধী অবস্থানে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনসহ বেশ কটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত বছর অক্টোবরে রাষ্ট্র সংস্কারে গঠন করা হয় সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, জনপ্রশান ও পুলিশ সংস্কার কমিশন। এই ছয়টি কমিশন চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যে তাদের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দেয়। এরপর ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ছয়টি কমিশনের প্রধানদের নিয়ে গঠন করা হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। ঐকমত্য কমিশনের দায়িত্ব হলো—রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনের সঙ্গে সংলাপ করে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো এবং একটি ‘জাতীয় সনদ’ প্রণয়ন করা।

গত ১২ ফেব্রুয়ারি গঠিত এই কমিশন ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে কাজ শুরু করে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সংস্কার কমিশনগুলোর দেওয়া সুপারিশের ভিত্তিতে ১৬৬টি প্রস্তাবের একটি তালিকা তৈরি করে রাজনৈতিক দল ও জোটের মতামত আহ্বান করে। এরপর সংস্কার প্রশ্নে সমঝোতায় পৌঁছাতে লিখিত মতামতের পাশাপাশি গত ২০ মার্চ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করে। গত ১৯ মে পর্যন্ত চলা প্রথম পর্বের সংলাপে ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও জোট অংশ নিয়ে তাদের মতামত তুলে ধরে। গত ৩ জুন দ্বিতীয় পর্বের সংলাপ শুরু হয়।

৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে দ্বিতীয় পর্বের সংলাপে এ পর্যন্ত ১৮টি বৈঠক হয়েছে। কমিশনের দেওয়া প্রস্তাব নিয়ে পারস্পরিক আলোচনায় অধিকাংশ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো গেছে। দলগুলো প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানোসহ ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল নির্ধারণ ও ‘সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ’ সংশোধনে সম্মত হয়েছে। এ ছাড়া সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কার, প্রধান বিচারপতির নিয়োগ প্রক্রিয়া নির্ধারণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদানের জন্য আইন প্রণয়ন, নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণ, বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্ট বেঞ্চ স্থাপন ও উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালত গঠনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একমত হয়েছে।

তবে সংযোজন-বিয়োজনের পাশাপাশি একাধিক বিকল্প প্রস্তাব দিয়েও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবে সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেনি দলগুলো। সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের প্রস্তাব বাতিল করা হয়েছে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের কাঠামো, বিশেষত উচ্চকক্ষ গঠন, সদস্য মনোনয়ন ও নির্বাচনের পদ্ধতি এবং এখতিয়ার নিয়ে আলোচনা এখনো শেষ করা যায়নি। নারীদের সংরক্ষিত আসনসংখ্যা ও সরাসরি নির্বাচন নিয়ে সমঝোতা হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা শেষ হলেও সিদ্ধান্ত জানা যায়নি। সংবিধান সংশোধন ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ধরন নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় সংবিধানের মূলনীতি নিয়ে পরস্পরবিরোধী অবস্থান রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো।

রাষ্ট্রীয় কার্যাবলিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনা এবং রাষ্ট্রীয় অঙ্গ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ভারসাম্য নিশ্চিত করতে ৯ সদস্যের একটি জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) প্রস্তাব করেছিল ঐকমত্য কমিশন। এনসিসির মাধ্যমে সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের প্রস্তাবও করে কমিশন। কিন্তু এতে নির্বাহী বিভাগ তথা প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমে যাবে যুক্তিতে বিএনপিসহ কয়েকটি দল বিরোধিতা করে। পরে কমিশন সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ নিয়োগে সাংবিধানিক কমিটি গঠনের প্রস্তাব করলে তাও টেকেনি। সবশেষে গত ২৩ জুলাই সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য নতুন প্রস্তাব করেছে কমিশন।

শুরুতে আপত্তি থাকলেও নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে স্পিকারের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের বাছাই কমিটি গঠন প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে বিএনপিসহ অন্য দলগুলো। স্পিকারের নেতৃত্বে বাছাই কমিটিতে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, বিরোধীদলীয় ডেপুটি স্পিকার ও প্রধান বিচারপতির প্রতিনিধি। তবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি), মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) এবং ন্যায়পাল নিয়োগে বাছাই কমিটি গঠনে আপত্তি জানিয়েছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো।

এদিকে সিপিবিসহ কয়েকটি দলের আপত্তির পরও কমিশন প্রস্তাবিত দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের বিষয়ে একমত হয় অধিকাংশ দল। তবে আলোচনা আটকে যায় সংসদের উচ্চকক্ষের ক্ষমতাকাঠামো ও নির্বাচনপদ্ধতি নিয়ে। জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) অধিকাংশ দল উচ্চকক্ষে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নিলে বিএনপিসহ কয়েকটি দল বিপক্ষে অবস্থান নেয়। তারা নিম্নকক্ষের আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন চায়।

ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব অনুয়ায়ী, সংসদের উচ্চকক্ষ হবে ‘অতিরিক্ত তত্ত্বাবধায়নমূলক’ একটি স্তর। যা সংসদের নিম্নকক্ষের বা সংসদে সরকারি দলের নিরঙ্কুশ আধিপত্য ও একচ্ছত্র ক্ষমতা কমাবে। কিন্তু উচ্চকক্ষ গঠন করা হলে সেটা সম্ভব হবে না; বরং এটি নির্ভর করবে কোন পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষের নির্বাচন হবে, উচ্চকক্ষের কেমন ক্ষমতা থাকবে, সেটার ওপর। প্রস্তাবে উচ্চকক্ষকে শুধু সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তার পরও উচ্চকক্ষে বিল (আইনের খসড়া) পর্যালোচনা, সাময়িকভাবে বিল আটকে রাখা ও সুপারিশ দেওয়ার সুযোগ ভালো আইন তৈরিতে সহায়ক হতে পারে। কিন্তু সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে, সেটা সম্ভব হবে না। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনে তুলনামূলক বেশিসংখ্যক দলের প্রতিনিধিত্ব থাকবে উচ্চকক্ষে। এমনকি নিম্নকক্ষে আসন না পেলেও ভোটের অনুপাতে কোনো কোনো দলের উচ্চকক্ষে আসন পাওয়ার সুযোগ থাকবে। তবে বিএনপিসহ কয়েকটি দল পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষের নির্বাচনের বিপক্ষে। তারা নিম্নকক্ষে প্রাপ্ত আসনের ভিত্তিতে উচ্চকক্ষে আসন বণ্টনের প্রস্তাব দিয়েছে। ফলে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের বিষয় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

তবে কোনো বিষয়ে একমত না হলে ‘জাতীয় সনদে’ কোনো দল চাইলে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ (আপত্তি) দিতে পারবে বলে কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর আপত্তি সত্ত্বেও ‘একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানের পদে থাকতে পারবেন না’ বলে সিদ্ধান্ত জানিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হবেন, সে বিষয়েও আগামী রবিবার সিদ্ধান্ত জানাবে কমিশন। অন্য অমীমাংসিত বিষয়গুলো ‘নোট অব ডিসেন্টে’র মাধ্যমে সমাধান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। পরে কোন প্রস্তাবে আপত্তি তা উল্লেখ করেই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করবে দলগুলো।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, ‘সংস্কার প্রস্তাব আলোচনায় বেশ কিছু ক্ষেত্রে ঐকমত্যে পৌঁছেছি। অনেক ক্ষেত্রে কাছাকাছি আসছি। অনেক বিষয়ে অনেক প্রস্তাব এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। কোনো কোনো প্রস্তাবে কিছু দল ভিন্নমত ব্যক্ত করেছে। এই দলগুলো জাতীয় সনদে সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবগুলোতে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিতে পারবে।’

তিনি বলেন, ‘দ্রুততম সময়ে যতদূর সম্ভব ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে একটি জাতীয় সনদ তৈরি করতে চায় কমিশন। জুলাই মাসের মধ্যেই এই কাজ সম্পন্ন করতে চাই। রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা অব্যাহত থাকলে সেটা সম্ভব হবে বলে আশা করি।’

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সঞ্চয় করে রাখুন

আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

ঐকমত্য কমিশন সমঝোতায় পৌঁছাতে জোর চেষ্টা চালাচ্ছে

আপডেট সময় ১০:৫৫:১২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৬ জুলাই ২০২৫

রাষ্ট্র সংস্কারের প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছাতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। যে কারণে দলগুলোর মতামতের পর প্রস্তাবে প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে, নতুন প্রস্তাবের মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। সমঝোতায় পৌঁছাতে বাতিল করা হয়েছে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের প্রস্তাব। বিকল্প হিসেবে সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে সাংবিধানিক কমিটি গঠনের নতুন প্রস্তাব করা হয়।
তাতেও সমঝোতা না হওয়ায় সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে বাছাই কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়। তবে নির্বাচন কমিশন ছাড়া অন্য প্রতিষ্ঠানে এই কমিটি গঠনে আপত্তি রয়েছে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর। ফলে এ নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর সম্ভাবনা কম। একইভাবে দলগুলোর পরস্পরবিরোধী অবস্থানে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনসহ বেশ কটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত বছর অক্টোবরে রাষ্ট্র সংস্কারে গঠন করা হয় সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, জনপ্রশান ও পুলিশ সংস্কার কমিশন। এই ছয়টি কমিশন চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যে তাদের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দেয়। এরপর ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ছয়টি কমিশনের প্রধানদের নিয়ে গঠন করা হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। ঐকমত্য কমিশনের দায়িত্ব হলো—রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনের সঙ্গে সংলাপ করে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো এবং একটি ‘জাতীয় সনদ’ প্রণয়ন করা।

গত ১২ ফেব্রুয়ারি গঠিত এই কমিশন ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে কাজ শুরু করে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সংস্কার কমিশনগুলোর দেওয়া সুপারিশের ভিত্তিতে ১৬৬টি প্রস্তাবের একটি তালিকা তৈরি করে রাজনৈতিক দল ও জোটের মতামত আহ্বান করে। এরপর সংস্কার প্রশ্নে সমঝোতায় পৌঁছাতে লিখিত মতামতের পাশাপাশি গত ২০ মার্চ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করে। গত ১৯ মে পর্যন্ত চলা প্রথম পর্বের সংলাপে ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও জোট অংশ নিয়ে তাদের মতামত তুলে ধরে। গত ৩ জুন দ্বিতীয় পর্বের সংলাপ শুরু হয়।

৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে দ্বিতীয় পর্বের সংলাপে এ পর্যন্ত ১৮টি বৈঠক হয়েছে। কমিশনের দেওয়া প্রস্তাব নিয়ে পারস্পরিক আলোচনায় অধিকাংশ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো গেছে। দলগুলো প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানোসহ ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল নির্ধারণ ও ‘সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ’ সংশোধনে সম্মত হয়েছে। এ ছাড়া সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কার, প্রধান বিচারপতির নিয়োগ প্রক্রিয়া নির্ধারণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদানের জন্য আইন প্রণয়ন, নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণ, বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্ট বেঞ্চ স্থাপন ও উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালত গঠনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একমত হয়েছে।

তবে সংযোজন-বিয়োজনের পাশাপাশি একাধিক বিকল্প প্রস্তাব দিয়েও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবে সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেনি দলগুলো। সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের প্রস্তাব বাতিল করা হয়েছে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের কাঠামো, বিশেষত উচ্চকক্ষ গঠন, সদস্য মনোনয়ন ও নির্বাচনের পদ্ধতি এবং এখতিয়ার নিয়ে আলোচনা এখনো শেষ করা যায়নি। নারীদের সংরক্ষিত আসনসংখ্যা ও সরাসরি নির্বাচন নিয়ে সমঝোতা হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা শেষ হলেও সিদ্ধান্ত জানা যায়নি। সংবিধান সংশোধন ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ধরন নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় সংবিধানের মূলনীতি নিয়ে পরস্পরবিরোধী অবস্থান রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো।

রাষ্ট্রীয় কার্যাবলিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনা এবং রাষ্ট্রীয় অঙ্গ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ভারসাম্য নিশ্চিত করতে ৯ সদস্যের একটি জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) প্রস্তাব করেছিল ঐকমত্য কমিশন। এনসিসির মাধ্যমে সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের প্রস্তাবও করে কমিশন। কিন্তু এতে নির্বাহী বিভাগ তথা প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমে যাবে যুক্তিতে বিএনপিসহ কয়েকটি দল বিরোধিতা করে। পরে কমিশন সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ নিয়োগে সাংবিধানিক কমিটি গঠনের প্রস্তাব করলে তাও টেকেনি। সবশেষে গত ২৩ জুলাই সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য নতুন প্রস্তাব করেছে কমিশন।

শুরুতে আপত্তি থাকলেও নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে স্পিকারের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের বাছাই কমিটি গঠন প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে বিএনপিসহ অন্য দলগুলো। স্পিকারের নেতৃত্বে বাছাই কমিটিতে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, বিরোধীদলীয় ডেপুটি স্পিকার ও প্রধান বিচারপতির প্রতিনিধি। তবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি), মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) এবং ন্যায়পাল নিয়োগে বাছাই কমিটি গঠনে আপত্তি জানিয়েছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো।

এদিকে সিপিবিসহ কয়েকটি দলের আপত্তির পরও কমিশন প্রস্তাবিত দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের বিষয়ে একমত হয় অধিকাংশ দল। তবে আলোচনা আটকে যায় সংসদের উচ্চকক্ষের ক্ষমতাকাঠামো ও নির্বাচনপদ্ধতি নিয়ে। জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) অধিকাংশ দল উচ্চকক্ষে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নিলে বিএনপিসহ কয়েকটি দল বিপক্ষে অবস্থান নেয়। তারা নিম্নকক্ষের আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন চায়।

ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব অনুয়ায়ী, সংসদের উচ্চকক্ষ হবে ‘অতিরিক্ত তত্ত্বাবধায়নমূলক’ একটি স্তর। যা সংসদের নিম্নকক্ষের বা সংসদে সরকারি দলের নিরঙ্কুশ আধিপত্য ও একচ্ছত্র ক্ষমতা কমাবে। কিন্তু উচ্চকক্ষ গঠন করা হলে সেটা সম্ভব হবে না; বরং এটি নির্ভর করবে কোন পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষের নির্বাচন হবে, উচ্চকক্ষের কেমন ক্ষমতা থাকবে, সেটার ওপর। প্রস্তাবে উচ্চকক্ষকে শুধু সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তার পরও উচ্চকক্ষে বিল (আইনের খসড়া) পর্যালোচনা, সাময়িকভাবে বিল আটকে রাখা ও সুপারিশ দেওয়ার সুযোগ ভালো আইন তৈরিতে সহায়ক হতে পারে। কিন্তু সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে, সেটা সম্ভব হবে না। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনে তুলনামূলক বেশিসংখ্যক দলের প্রতিনিধিত্ব থাকবে উচ্চকক্ষে। এমনকি নিম্নকক্ষে আসন না পেলেও ভোটের অনুপাতে কোনো কোনো দলের উচ্চকক্ষে আসন পাওয়ার সুযোগ থাকবে। তবে বিএনপিসহ কয়েকটি দল পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষের নির্বাচনের বিপক্ষে। তারা নিম্নকক্ষে প্রাপ্ত আসনের ভিত্তিতে উচ্চকক্ষে আসন বণ্টনের প্রস্তাব দিয়েছে। ফলে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের বিষয় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

তবে কোনো বিষয়ে একমত না হলে ‘জাতীয় সনদে’ কোনো দল চাইলে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ (আপত্তি) দিতে পারবে বলে কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর আপত্তি সত্ত্বেও ‘একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানের পদে থাকতে পারবেন না’ বলে সিদ্ধান্ত জানিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হবেন, সে বিষয়েও আগামী রবিবার সিদ্ধান্ত জানাবে কমিশন। অন্য অমীমাংসিত বিষয়গুলো ‘নোট অব ডিসেন্টে’র মাধ্যমে সমাধান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। পরে কোন প্রস্তাবে আপত্তি তা উল্লেখ করেই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করবে দলগুলো।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, ‘সংস্কার প্রস্তাব আলোচনায় বেশ কিছু ক্ষেত্রে ঐকমত্যে পৌঁছেছি। অনেক ক্ষেত্রে কাছাকাছি আসছি। অনেক বিষয়ে অনেক প্রস্তাব এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। কোনো কোনো প্রস্তাবে কিছু দল ভিন্নমত ব্যক্ত করেছে। এই দলগুলো জাতীয় সনদে সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবগুলোতে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিতে পারবে।’

তিনি বলেন, ‘দ্রুততম সময়ে যতদূর সম্ভব ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে একটি জাতীয় সনদ তৈরি করতে চায় কমিশন। জুলাই মাসের মধ্যেই এই কাজ সম্পন্ন করতে চাই। রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা অব্যাহত থাকলে সেটা সম্ভব হবে বলে আশা করি।’