দেশে বেড়েই চলেছে অপরাধ। প্রতিদিনই একাধিক খুনের ঘটনা ঘটছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে ছিনতাই, ডাকাতি। বাসায় হানা দিচ্ছে দুর্বৃত্তরা।পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দফায় দফায় বৈঠক করছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। এ অবস্থায় গতকাল সোমবার আইজিপি সারা দেশে চলমান বিশেষ অভিযান আরো জোরদার করার নির্দেশ দিয়েছেন। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য।সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটেছে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে।গত শনিবার বিকেলে এখানে দুই পক্ষের গোলাগুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল কিশোর রহমত ওরফে সার্জন। গতকাল সকাল ৮টায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এ নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে এলাকাটিতে সন্ত্রাসী হামলায় অন্তত ৯ জন নিহত হলো। তাদের মধ্যে নারী, শিশুও রয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, মোহাম্মদপুর থানা এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে জনমনে যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, তা নিরসন করে স্বাভাবিক পরিস্থিতি বজায় রাখতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) বদ্ধপরিকর।
পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তদন্তে উঠে এসেছে, মাদক কারবারিরা ব্যাপকভাবে জেনেভা ক্যাম্পে প্রভাব বিস্তার করে আছে দীর্ঘদিন ধরে। সরকার পরিবর্তনের পর তারা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। প্রায়ই ক্যাম্পের ভেতরে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে।
এরপর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিশেষ অভিযান শুরু করে যৌথ বাহিনী।গতকাল জেনেভা ক্যাম্প এলাকা থেকে ৩৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে যৌথ বাহিনী। এ নিয়ে এই এলাকায় সাম্প্রতিক অভিযানে অপরাধে জড়িত অভিযোগে অর্ধশতাধিক ব্যক্তি গ্রেপ্তার হলো।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, সাম্প্রতিক বিশেষ অভিযানে (২৭ অক্টোবর পর্যন্ত) দুই হাজার ৪৫৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ ও ডাকাত ২০০ জন; তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী ১৬ জন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলায় অভিযুক্ত এক হাজার ১৪০ জন, মাদকদ্রব্য উদ্ধার সংক্রান্ত ঘটনায় এক হাজার ১৪৪ জন এবং অবৈধ অস্ত্রধারী ৫৫ জন রয়েছে।
গতকাল বিকেলে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, গত ২৭ অক্টোবর দিন ও রাতে মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান, চাঁদ উদ্যান ও জেনেভা ক্যাম্প থেকে সেনাবাহিনী ও পুলিশের যৌথ অভিযানে খুনের আসামি, ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যসহ ২২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে জেনেভা ক্যাম্প মাদকচক্রের দুজন শীর্ষ মাদক কারবারি, ১০ জন ছিনতাইকারী এবং কিশোর গ্যাংয়ের সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
আইএসপিআর জানায়, দেশের চলমান পরিস্থিতিতে জনসাধারণের জানমাল ও সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার সার্বিক নিরাপত্তা এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ড রোধ ও আইনের শাসন সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে দেশব্যাপী নিরপেক্ষতা ও পেশাদারির সঙ্গে কাজ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। গত দুই দিনের বিশেষ অভিযানে বেশ কিছু চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ গ্রেপ্তার হওয়ায় নিরাপত্তাহীনতায় নিমজ্জিত মোহাম্মদপুরবাসীর মনে স্বস্তি ফিরে আসছে।
বিশেষ অভিযান জোরদারের নির্দেশ আইজিপির
সন্ত্রাসী, ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ, মাদক কারবারি, কিশোর গ্যাং ইত্যাদির বিরুদ্ধে ১৮ অক্টোবর থেকে চলমান বিশেষ অভিযান আরো জোরদার করতে পুলিশের সব ইউনিট প্রধানকে গতকাল এক বিশেষ বার্তায় নির্দেশ দিয়েছেন আইজিপি মো. ময়নুল ইসলাম।
অভিযানে অপরাধপ্রবণ এলাকায় কম্বিং অপারেশন পরিচালিত হচ্ছে। পুলিশের স্থায়ী ও অস্থায়ী চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। পুলিশি টহল জোরদার এবং গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। মোবাইল ও মোটরসাইকেল প্যাট্রল টিম বাড়ানো হয়েছে। ডিএমপি এলাকায় ১৫০টি স্থায়ী ও মোবাইল চেকপোস্ট, ৩০০টি মোটরসাইকেল টিম ও ২৫০টি টহল টিম কার্যকর রয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের (এআইজি মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় যারা চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধেও মামলা, গ্রেপ্তারসহ আইনি পদক্ষেপ চলমান।
ক্যাম্পে বিশেষ অভিযানে পুলিশ
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী কিছুদিন নিষ্ক্রিয় থাকার সুযোগে অপরাধীরা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, ৫ আগস্টের পর মোহাম্মদপুর থানায় এ পর্যন্ত ১০টি হত্যা মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ২৭ আসামিকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে। একই সময় দুটি ডাকাতি মামলা হয়েছে। এতে ১৪ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
পুলিশ আরো বলেছে, এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে মোহাম্মদপুর থানা এলাকায় ফুট প্যাট্রল চালু করা হয়েছে। এ ছাড়া অপরাধপ্রবণ এলাকাগুলোতে নিয়মিত ব্লক রেইড, চেকপোস্ট পরিচালনা করে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও চি
হ্নিত
অপরাধীদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। মোহাম্মদপুর থেকে বেশ কিছু অস্ত্র উদ্ধার এবং এসংক্রান্ত ঘটনায় ১৭ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এর মধ্যে রয়েছে ২০ রাউন্ড গুলিসহ একটি রিভলবার, দুটি পিস্তল, আটটি রামদা, পেট্রলবোমা তৈরির কাচের বোতল ১৫টি, পেট্রল ১০ লিটার, ছয়টি চায়নিজ কুড়াল, একটি টেঁটা, আটটি ছুরি ও পাঁচটি বড় চাপাতি। থানা এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনায় আটটি মামলা হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত ১৭ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়। আসামিদের কাছ থেকে একটি অটোরিকশা, একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা, চারটি চাপাতি, দুটি সামুরাই ও দুই হাজার ১৬০ টাকা উদ্ধার করা হয়।
এ সময় মোহাম্মদপুর থানায় চারটি অপহরণ মামলাও হয়েছে জানিয়ে ডিসি তালেবুর বলেন, ঘটনার সঙ্গে জড়িত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার এবং তাদের কাছ থেকে চারজন ভিকটিমকেই উদ্ধার করা হয়েছে।
ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের ডিসি মোহাম্মদ রুহুল কবীর খান গতকাল দুপুরে মোহাম্মদপুর থানায় এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান, ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে মোহাম্মদপুর থেকে গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে ছিনতাই, ডাকাতি ও চুরির মামলা আছে। ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনাগুলোর সঙ্গে তাদের যোগসাজশ পাওয়া যাচ্ছে। মোহাম্মদপুরে ছিনতাই ও ডাকাতির ছোট ছোট দল রয়েছে।
যাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তাদের অনেকেই নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রুহুল কবীর বলেন, যখন অভিযান চালানো হয়, তখন চিহ্নিত ও অভ্যাসগত অপরাধীর বাইরেও কেউ কেউ আটক হয়। এ ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাইয়ের পর নির্দোষ কাউকে পাওয়া গেলে তাকে মুচলেকা নিয়ে অভিভাবকদের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়। চলমান অভিযানে এমন দুজন শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়েছিল। যাচাই-বাছাইয়ের পর তাদের পরিবারের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি মোহাম্মদপুরে ছিনতাই, ডাকাতি ও খুনখারাবি বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে সন্ত্রাসমুক্ত মোহাম্মদপুরের দাবিতে এলাকাবাসী গত শনিবার মোহাম্মদপুর থানার সামনে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে। এমন অবস্থার জন্য তারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে দায়ী করেছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দৃশ্যমান অগ্রগতির জন্য তারা পুলিশকে তিন দিনের সময় বেঁধে দেয়। এরপর শনিবার রাতে যৌথ বাহিনীর অভিযানে ৪৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গতকাল আরো ৩৪ জনকে গ্রেপ্তারের কথা জানাল পুলিশ।