বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে ২০২৪ সালের শিক্ষার্থী নেতৃত্বাধীন জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। দুজনের অনুপস্থিতিতে হওয়া এ বিচার আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের মানদণ্ড পূরণে ব্যর্থ হয়েছে বলে উদ্বেগ জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।
এইচআরডব্লিউ এক বিবৃতিতে বলেছে, দুজনেরই অনুপস্থিতিতে বিচার হয়েছে এবং তারা নিজেদের পছন্দের আইনজীবীর মাধ্যমে প্রতিনিধিত্ব পাননি, যা গুরুতর মানবাধিকার উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। মামলার তৃতীয় আসামি সাবেক পুলিশপ্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে রাজসাক্ষী হিসেবে জবানবন্দির পর সাজা কমিয়ে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
মামলায় তিন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল—বিক্ষোভকারীদের ওপর সংগঠিত আক্রমণ, নিরাপত্তা বাহিনী ও দলীয় সমর্থকদের দিয়ে ব্যাপক দমন–পীড়নের নির্দেশ, ড্রোন, হেলিকপ্টার ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি এবং নিরাপত্তা বাহিনীর তিনটি হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে বা শাস্তি দিতে ব্যর্থ হওয়া। প্রসিকিউশন মোট ৫৪ জন সাক্ষী হাজির করে, যাদের অর্ধেক বিশেষজ্ঞ ও বাকিরা ভুক্তভোগী বা তাদের পরিবার। প্রমাণ হিসেবে শেখ হাসিনার কথোপকথনের অডিও রেকর্ডিং উপস্থাপন করা হয়, যেখানে তাকে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিতে শোনা যায় ।
৪৫৩ পৃষ্ঠার রায়ে বিচারকেরা বলেন, রোম স্ট্যাটিউটের ৭ নম্বর অনুচ্ছেদকে বিচারকার্যের ভিত্তি ধরা হয়েছে। ভুক্তভোগীদের সাক্ষ্য আদালতের সিদ্ধান্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। রায়ে উল্লেখ করা হয়, সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা নিরাপত্তা বাহিনীর ‘শৃঙ্খলাভঙ্গ’ উল্লেখ করলেও তিনি নিজের ‘নেতৃত্বের দায়’ স্বীকার করেছেন।
এইচআরডব্লিউ বলে, বাংলাদেশের ইতিহাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল রাজনৈতিক মামলায় ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। হাসিনা সরকারের সময় গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতনের ন্যায়বিচার জরুরি। তবে, তা অবশ্যই স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রক্রিয়ায় হওয়া উচিত।
২০২৪ সালে শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পর অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান মুহাম্মদ ইউনুস ক্ষমতায় আসেন। তার সরকার নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন সংশোধন করে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও কমান্ড রেসপনসিবিলিটির সংজ্ঞা রোম স্ট্যাটিউটের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে। গুমকে স্পষ্টভাবে অপরাধ হিসেবে যুক্ত করা হয়। তবে ২০২৫ সালের সংশোধনীতে ট্রাইব্যুনালকে রাজনৈতিক দল ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়ায় উদ্বেগ জানায় সংস্থাটি। রায়ে আওয়ামী লীগ ভাঙার নির্দেশ না থাকলেও হাসিনা ও আসাদুজ্জামানের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। শেখ হাসিনা আরও তিনটি মামলার আসামি—যার দুটি গুম ও একটি ২০১৩ সালের গণহত্যা সংক্রান্ত।
এইচআরডব্লিউ জানায়, সংবিধানের ৪৭(৩) ও ৪৭এ ধারা আন্তর্জাতিক অপরাধে অভিযুক্তদের আইনি সুরক্ষা, ন্যায়বিচার ও প্রতিকার চাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। তাই সবার জন্য সমান সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করা এবং মৃত্যুদণ্ড স্থগিত করে তা বিলোপের দিকে অগ্রসর হওয়ার তাগিদ দেয় সংস্থাটি।
২০২৫ সালের জুলাইয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার দপ্তর ও বাংলাদেশ সরকার মানবাধিকার সহায়তা বাড়াতে তিন বছরের সমঝোতা স্মারকে সই করে। অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছে। এইচআরডব্লিউ বলছে, আন্তর্জাতিক সহায়তা পেতে মৃত্যুদণ্ড স্থগিতের সিদ্ধান্ত জরুরি।
রায় ঘোষণার পর বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতকে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামানকে প্রত্যর্পণের অনুরোধ জানিয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, প্রত্যর্পণের ক্ষেত্রে ভারতকে অবশ্যই ন্যায়সংগত প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে; এমন কোনো দেশে কাউকে পাঠানো উচিত নয়, যেখানে মৃত্যুদণ্ড বা অন্যায্য বিচারের ঝুঁকি রয়েছে।
এইচআরডব্লিউর এশিয়া বিভাগের উপপরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, হাসিনা সরকারের আমলে অধিকার লঙ্ঘনের শিকার ব্যক্তিরা ন্যায়বিচার ও ক্ষতিপূরণের অধিকার রাখেন, তবে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা মানে অভিযুক্তদের অধিকারও সুরক্ষিত করা—এর মধ্যে মৃত্যুদণ্ড বিলোপ একটি জরুরি পদক্ষেপ।

ডিজিটাল ডেস্ক 



















