ময়মনসিংহ , মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৬ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
নোটিশ :
প্রতিটি জেলা- উপজেলায় একজন করে ভিডিও প্রতিনিধি আবশ্যক। যোগাযোগঃ- Email- matiomanuss@gmail.com. Mobile No- 017-11684104, 013-03300539.

তদন্তে বেরিয়ে এলো আকাশ মণ্ডল থেকে ইরফান নাম কেন

চাঁদপুরের মেঘনা নদীতে জাহাজে সাত খুনের ঘটনায় মামলা হওয়ার পর এবং আহত জুয়েলের দেওয়া তথ্যে বেরিয়ে আসে আকাশ মণ্ডল ইরফানের নাম। ঘটনাটি ডাকাতি বলে প্রচার হলেও ঘটনার দৃশ্যপট দেখে অন্য কিছু সন্দেহ হয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর।

আর ইরফান নামে ব্যাক্তিকে গ্রেপ্তার করার পর ঘটনার মোড় ঘুরে অন্য দিকে। নাম গোপন রেখে জাহাজে চাকরি নেওয়ার কারণ নৌপুলিশকে জানিয়েছেন ২৬ বছর বয়স্ক ইরফান।

এর মধ্যে তদন্তে তার এলাকার জীবনের পেছনের নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ড উঠে এসেছে।শুক্রবার (২৭ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় এ তথ্য জানিয়েছেন চাঁদপুর নৌপুলিশ সুপার কার্যালয়ের উপ-পরিদর্শক শেখ আব্দুস সবুর।

তিনি বলেন, রিমান্ডে ইরফান জানিয়েছেন তিনি ভৈরবে নৌযানে কর্মরত অবস্থায় কলেমা পড়ে মুসলিম ধর্মে ধর্মান্তরিত হন। মূলত তার পেছনের জীবনের ছোটখাটো অপরাধমূলক কাজকে আড়ালে রেখে ভালো ছেলে হিসেবে নিজেকে মেলে ধরতেই ইরফান নাম দিয়ে জাহাজে খালাসি পদে চাকরি নেন।

তবে তার আইডি কার্ডে এখনো আকাশ মণ্ডল নামটিই রয়েছে।কুমিল্লার র‍্যাব ১১-এর উপ-পরিদর্শক মো. তারেক বলেন, ইরফানকে আমরা বাগেরহাটের চিতলমারী থেকে গ্রেপ্তার করি। সেখানেই তিনি আত্মগোপনে ছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন বেতনভাতা আন পাওয়ায় রাগ ও ক্ষোভের থেকে একাই তিনি এই সাতটি খুন করে ফেলেছেন।

পরে ধরা পড়ার ভয়ে একে একে আরো ছয়জনকে তিনি হত্যা করেন। আরেকজনকে একই কায়দায় আঘাত করলেও ওই সময় মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার মতো বড় আঘাত না হওয়ায় প্রাণে বেঁচে যান জুয়েল। তার শনাক্তের কারণেই চাঞ্চল্যকর সাত খুনের রহস্য উন্মোচিত ও খুনি চিহ্নিত হয়েছে।

আর কার্গো জাহাজ এমডি আল বাখেরার মালিক মাহবুব মোর্শেদ বলেন, ইরফান নাম দিয়ে আমার জাহাজে সে খালাসির পদে চাকরি নিয়েছিল। তাকে বেতনভাতাসহ অন্য সুবিধা দেওয়া হতো না এমন অভিযোগ সঠিক না। আমি সাত খুনের ঘটনায় অজ্ঞাতনামা ডাকাতদল দেখিয়ে ২৪ ডিসেম্বর রাতে হাইমচর থানায় মামলা করেছি।

পুলিশ ও স্থানীয়দের থেকে প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে জানাগেছে, ইরফান তার নিজ এলাকা বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট উপজেলার মূলঘর গ্রামেও আকাশ মণ্ডল নামেই পরিচিত। তার বাবা জগদীশ মণ্ডল মারা যাওয়ার পরই তারসহ পুরো পরিবারের অধপতন শুরু হয়। তার মা অভাব-অনটন সহ্য করতে না পেরে তাদের দুই ভাইকে ফেলে ইসলাম ধর্মগ্রহণ করে মুসলিম যুবকের সঙ্গে বিয়ে করে চলে যান।

পরে নানা-নানির কাছে সে থাকা শুরু করার একপর্যায়ে কিছু দিনের ব্যবধানে তারাও মারা যান। এরপর তার একমাত্র আপন বড়ভাই বিধান মণ্ডলও মুসলিম মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে ইসলাম ধর্মগ্রহণ করে আবির হোসেন নাম নিয়ে সেও আলাদা থাকতে শুরু করে।

ইরফান এর প্রতিবেশী জিহাদুল ইসলাম ও মো. জুয়েল বলেন, আকাশ নামের ছেলেটি ২০১৮ সালের দিকে একটি মুসলিম মেয়ের সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে এলাকা ছাড়া হয়। এরপর ২০২২ সালের দিকে পুনরায় এলাকায় এসে তার ভাইয়ের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা হওয়ায় আবার নিরুদ্দেশ হয়। এখন ফেসবুকে দেখে জানলাম সে জাহাজে সাতজনকে খুন করেছে। তবে আকাশ অভাবের তাড়নায় এলাকায় মানুষের ক্ষেত, পুকুরে শাক ও মাছ চুরির অপরাধে জড়িয়েছিল। তবে কাউকে মারধর করা কিংবা আঘাত করার মতো দুঃসাহস কখনো দেখায়নি।

আকাশের বড়ভাই আবির হোসেন বলেন, আমার নানা-নানি থাকতেন সরকারি জায়গায় ঝুপড়িঘরে। তাদের মৃত্যুর পর আমিও সেখানেই থাকি। আমাদের পৈতৃক নিবাস মোল্লাহাট উপজেলার কোদালিয়া গ্রামে হলেও ছোটবেলায় বাবার মৃত্যুর পর মা ধর্মান্তরিত হয়ে অন্যত্র চলে যাওয়ায় আমরা দুই ভাই নানা-নানির কাছেই বেড়ে উঠি। আমি ফলতিতা বাজারে সিলিন্ডার গ্যাস বিক্রির একটা ছোট দোকান দিয়েছিলাম।

সেখানে কাজের সময় আকাশ একটি নারীর সঙ্গে প্রেমঘটিত ঘটনায় এলাকা ছাড়ে। এরপর আর ওই দোকান সেখানে বেশি দিন টেকেনি। গত শীতে একদিনের জন্য সে বাড়িতে আসলে তাকে বকাঝকা করে তাড়িয়ে দিই। এরপর থেকেই সে জাহাজে জাহাজে কাজ করে এবং আমার সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ নেই। তবে এলাকায় থাকাকালীন সে বিয়ে করেনি এবং মাছ ধরা ও দিনমজুরির কাজ করত।

এদিকে চিকিৎসাধীন জুয়েল নৌপুলিশকে জানিয়েছেন, এই ছেলেই ছিল সেই ঘাতক এবং সেই ছিল জাহাজের নিখোঁজ নবম ব্যক্তি।

বিষয়টি নিশ্চিত করে জেলা প্রশাসকের চার সদস্যের তদন্ত কমিটির সদস্য চাঁদপুর নৌপুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ আল মামুন। তিনি জানান, গলায় অসুস্থতায় কথা বলতে না পারলেও কাগজে ৯ জনের নাম লিখেছিলেন। সেখানে হতাহতের আটজন বাদে অন্য নামটি মূলত ইরফানই ছিল ওই ব্যক্তি যে তাকে গলায় জখম করেছিল।

তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, জাহাজটিতে কোনো সিসি ক্যামেরা ছিল না। সবাই ঘুমন্ত ছিলেন এবং ওই দিন সবাই কক্ষের দরজা খোলা রেখেছিল অর্থাৎ দরজা টানা ছিল; ছিটকানি আটকানো ছিল না। দরজা ভাঙা না থাকায় বিষয়টি সহজভাবে বুজা গেছে এবং জুয়েলের কাছ থেকে এটি নিশ্চিত হয়েছি। তবে জুয়েল ভেতর থেকে দরজা লক করায় মূলত প্রাণে বেঁচে ছিলেন। দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কাজ এগিয়ে নিচ্ছি আমরা।

চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের আরএমও ডা. আসিবুল ইসলাম আসিব বলেন, জাহাজে সাত খুনের প্রত্যেকটা মরদেহের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট আমি করেছি। প্রত্যেকেরই কানের একটু ওপরে মাথায় কোপ দিয়ে মারা হয়েছে। যে একজনকে ধরা হয়েছে, সে নেশাগ্রস্ত ছিল কিনা সন্দেহ রয়েছে। তার উগ্র আচরণের বহিঃপ্রকাশেই এমন কাণ্ড হতে পারে।

একজন সুস্থ ও স্বাভাবিক লোক কি এতগুলো মানুষকে রক্তাক্ত করে খুন করতে পারে? এ বিষয়ে চাঁদপুর মেডিকেল কলেজের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের প্রধান ডা. এএম ফরিদুজ্জামান বলেন, ইরফানের মোটিভ কী ছিলে এবং সে কি সাইকোপ্যাথ কিনা সেটি জানা এ ক্ষেত্রে জরুরি। ২৬-২৭ বয়সের যুবকরা এ ধরনের খুন করার ভালো সম্ভাবনা থাকে।

মূলত এ বয়সি যুবকদের যারা ‘এন্টি সোশ্যাল পার্সোনালিটি ডিজ-অর্ডারের মানুষ’ তারা দেশের বা সমাজের আইনকানুন মানতে চায় না। অর্থাৎ কোনো নিয়মে আবদ্ধ থাকতে চায় না। রাগ উঠলে এরা মারপিট, ভাঙচুর যে কোনো কিছু করতে পারে। পার্সোনালিটি যদি সিভিয়ার হয় সে ক্ষেত্রে এই বয়সি যুবকরা একজন সন্ত্রাসীতে পরিণত হতে পারে, কিংবা সে একজন সাইকোপ্যাথ হতে পারে।

তিনি আরো বলেন, এই বয়সটাতে এদের অপরাধবোধ কাজ করে না। এরা যে কাজ করে, সেটা কেন করে সেটাও তারা জানে না বা বুজতে চায় না। এরা খুব ছোটখাটো বিষয়েও ভাঙচুর ও মারধর পর্যন্ত করতে পারে। তার মারধরের স্বীকার লোকটি মারা গেল কিনা সেটিও তারা বুজতে চায় না বা তার বিবেককে সে নিয়ন্ত্রণ করে না।

আবার এ বয়সের ছেলেগুলো অনেক সময় তাদের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ইউরিন টেস্ট করলেই সে নেশা করত কিনা বেরিয়ে আসবে। ওই পার্সোনালিটি যুবকদের ক্রিমিনাল অ্যাক্টিভিটি থাকে। এই সমস্যা প্রবল হলে মার্ডার করাটা স্বাভাবিক। সে মূলত রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরেই এই হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটাতে পারে এবং এটা সুস্থ মস্তিষ্কে ঠাণ্ডা মাথাতেই করা সম্ভব।

এদিকে চাঁদপুর জেলা জজকোর্টের এপিপি অ্যাডভোকেট শরীফ মাহমুদ বলেন, আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থন করে আকাশ মণ্ডল ওরফে ইরফান বিচারককে বলেন, মানুষ ভুল করে। আমিও ভুল করেছি। আমাকে ক্ষমা করে দিন।

এই সাত খুনের ঘটনায় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হরিণা পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ইন্সপেক্টর মো. কালাম খান বলেন, ইরফান আমাদের কাছেই রয়েছে। সাত দিনের রিমান্ডের দুই দিনে তার থেকে অনেক তথ্যই পেয়েছি। বাকি দিনগুলোতে পূর্ণাঙ্গ তথ্য বের করব। আহত জুয়েলের সঙ্গেও আমার যোগাযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌযান পরিবহণের চাঁদপুর নৌ সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগের যুগ্ম পরিচালক শাহ মাহফুজ উল আলম মোল্লা বলেন, অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত জাহাজটিতে পাইলট ছিলেন না। এমনকি তাতে স্কট, সিসি ক্যামেরা, ভিএইচএফ যন্ত্রপাতিও ছিল না। সে ক্ষেত্রে জাহাজটি কীভাবে এতদিন নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নদীতে চলাচল করেছে? সে নিয়েও কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করছি। কেননা, অবৈধ রেজিস্ট্রেশনবিহীন কার্গো জাহাজের বিরুদ্ধে প্রায়ই আমরা জরিমানাসহ আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।

তিনি বলেন, ঘটনার খবর শুনেই ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। পরে দেখলাম জাহাজটি নোঙর করা ছিল না, বরং চরে আটকে ছিল। ওটাতে পাইলটও ছিল না। যার কারণে নির্দিষ্ট ক্যানেলের বাইরে দেখতে পাই জাহাজটি। ইরফান খালাসি পদে কাজ করতেন। মূলত খালাসিরা সাধারণত লস্করের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। তারা জাহাজের ডেকে মালামাল স্থানান্তর করত এবং ডেক বা যন্ত্রপাতি পরিষ্কার করে থাকে। কোনোভাবেই মাস্টারের ভূমিকায় জাহাজ চালানোর কথা না।

তবে দেখে দেখে হয়তো জাহাজ কিছু সময় চালাতে পারে, তবে দক্ষ চালক বা মাস্টারের মতো কখনই চালাতে পারে না। এ জন্যই হয়তো ইরফান যে সময়টুকু জাহাজটি চালিয়েছে, সেই সময়েই জাহাজটি নির্দিষ্ট ক্যানেলের বাইরে চলে যায় এবং চরে আটকা পড়ে এবং নোঙর করা ছিল না।

চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন বলেন, ৭২০  টন ইউরিয়া সার ছিল কার্গো জাহাজটিতে। তা অক্ষত হওয়ায় এবং এগুলো সরকারি সার হওয়ায় দ্রুত তা ওই জাহাজ থেকে আনলোড করে স্থানান্তরিত করতে অন্য একটি জাহাজ ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে। আইনি প্রক্রিয়া শেষে ওই জাহাজ থেকে মাল আনলোডের কাজ শুরু হবে।

তদন্ত টিমও তাদের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। এর আগে আমরা আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে লাশগুলো পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছি এবং জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতের প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকার চেক এবং নৌপুলিশের পক্ষ থেকে নগদ ১০ হাজার টাকার  দিয়েছি।

তিনি আরো বলেন, এখন পর্যন্ত চাঁদপুরের এই সাত খুনের ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণে এবং রহস্য উন্মোচনে শ্রম মন্ত্রণালয় ৫ সদস্য, জেলা প্রশাসন ৪ সদস্যের এবং জেলা পুলিশ তিন সদস্যের পৃথক তদন্ত টিম গঠন করেছে। যারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবেন।

গত ২২ ডিসেম্বর সকাল ৮টা থেকে ২৩ ডিসেম্বর দুপুর সাড়ে ১২টার মধ্যে যে কোনো সময়ে চাঁদপুরের হাইমচরের ঈশানবালাস্থ মনিপুর টেক খালপাড় সংলগ্ন এলাকায় জাহাজে সাতজন খুনের ঘটনাটি ঘটেছে বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়। এমভি আল বাখেরা কার্গো জাহাজটি ২২ ডিসেম্বর সকাল ৮টায় চট্টগ্রাম কাফকো জেটি থেকে ইউরিয়া সার বোঝাই করে চাঁদপুর মেঘনা নদী হয়ে সিরাজগঞ্জ জেলার বাঘাবাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়।

জাহাজটিতে মাস্টারসহ ৯ জন স্টাফ ছিল। ২৩ ডিসেম্বর সকালে খুনের ওই ঘটনা সামনে আসে। এতে এমডি আল বাখেরা জাহাজের মাস্টার গোলাম কিবরিয়া, গ্রিজার সজিবুল ইসলাম, লস্কর মাজেদুল ইসলাম, শেখ সবুজ, আমিনুর মুন্সী, ইঞ্জিনচালক সালাউদ্দিন ও বাবুর্চি রানা কাজী খুন হন। এ ছাড়া গুরুতর আহত হন জাহাজের সুকানি জুয়েল। তিনি বর্তমানে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নাক কান গলা বিভাগে চিকিৎসাধীন।

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সঞ্চয় করে রাখুন

আপলোডকারীর তথ্য

তদন্তে বেরিয়ে এলো আকাশ মণ্ডল থেকে ইরফান নাম কেন

আপডেট সময় ১১:৩৮:১৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪

চাঁদপুরের মেঘনা নদীতে জাহাজে সাত খুনের ঘটনায় মামলা হওয়ার পর এবং আহত জুয়েলের দেওয়া তথ্যে বেরিয়ে আসে আকাশ মণ্ডল ইরফানের নাম। ঘটনাটি ডাকাতি বলে প্রচার হলেও ঘটনার দৃশ্যপট দেখে অন্য কিছু সন্দেহ হয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর।

আর ইরফান নামে ব্যাক্তিকে গ্রেপ্তার করার পর ঘটনার মোড় ঘুরে অন্য দিকে। নাম গোপন রেখে জাহাজে চাকরি নেওয়ার কারণ নৌপুলিশকে জানিয়েছেন ২৬ বছর বয়স্ক ইরফান।

এর মধ্যে তদন্তে তার এলাকার জীবনের পেছনের নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ড উঠে এসেছে।শুক্রবার (২৭ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় এ তথ্য জানিয়েছেন চাঁদপুর নৌপুলিশ সুপার কার্যালয়ের উপ-পরিদর্শক শেখ আব্দুস সবুর।

তিনি বলেন, রিমান্ডে ইরফান জানিয়েছেন তিনি ভৈরবে নৌযানে কর্মরত অবস্থায় কলেমা পড়ে মুসলিম ধর্মে ধর্মান্তরিত হন। মূলত তার পেছনের জীবনের ছোটখাটো অপরাধমূলক কাজকে আড়ালে রেখে ভালো ছেলে হিসেবে নিজেকে মেলে ধরতেই ইরফান নাম দিয়ে জাহাজে খালাসি পদে চাকরি নেন।

তবে তার আইডি কার্ডে এখনো আকাশ মণ্ডল নামটিই রয়েছে।কুমিল্লার র‍্যাব ১১-এর উপ-পরিদর্শক মো. তারেক বলেন, ইরফানকে আমরা বাগেরহাটের চিতলমারী থেকে গ্রেপ্তার করি। সেখানেই তিনি আত্মগোপনে ছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন বেতনভাতা আন পাওয়ায় রাগ ও ক্ষোভের থেকে একাই তিনি এই সাতটি খুন করে ফেলেছেন।

পরে ধরা পড়ার ভয়ে একে একে আরো ছয়জনকে তিনি হত্যা করেন। আরেকজনকে একই কায়দায় আঘাত করলেও ওই সময় মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার মতো বড় আঘাত না হওয়ায় প্রাণে বেঁচে যান জুয়েল। তার শনাক্তের কারণেই চাঞ্চল্যকর সাত খুনের রহস্য উন্মোচিত ও খুনি চিহ্নিত হয়েছে।

আর কার্গো জাহাজ এমডি আল বাখেরার মালিক মাহবুব মোর্শেদ বলেন, ইরফান নাম দিয়ে আমার জাহাজে সে খালাসির পদে চাকরি নিয়েছিল। তাকে বেতনভাতাসহ অন্য সুবিধা দেওয়া হতো না এমন অভিযোগ সঠিক না। আমি সাত খুনের ঘটনায় অজ্ঞাতনামা ডাকাতদল দেখিয়ে ২৪ ডিসেম্বর রাতে হাইমচর থানায় মামলা করেছি।

পুলিশ ও স্থানীয়দের থেকে প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে জানাগেছে, ইরফান তার নিজ এলাকা বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট উপজেলার মূলঘর গ্রামেও আকাশ মণ্ডল নামেই পরিচিত। তার বাবা জগদীশ মণ্ডল মারা যাওয়ার পরই তারসহ পুরো পরিবারের অধপতন শুরু হয়। তার মা অভাব-অনটন সহ্য করতে না পেরে তাদের দুই ভাইকে ফেলে ইসলাম ধর্মগ্রহণ করে মুসলিম যুবকের সঙ্গে বিয়ে করে চলে যান।

পরে নানা-নানির কাছে সে থাকা শুরু করার একপর্যায়ে কিছু দিনের ব্যবধানে তারাও মারা যান। এরপর তার একমাত্র আপন বড়ভাই বিধান মণ্ডলও মুসলিম মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে ইসলাম ধর্মগ্রহণ করে আবির হোসেন নাম নিয়ে সেও আলাদা থাকতে শুরু করে।

ইরফান এর প্রতিবেশী জিহাদুল ইসলাম ও মো. জুয়েল বলেন, আকাশ নামের ছেলেটি ২০১৮ সালের দিকে একটি মুসলিম মেয়ের সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে এলাকা ছাড়া হয়। এরপর ২০২২ সালের দিকে পুনরায় এলাকায় এসে তার ভাইয়ের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা হওয়ায় আবার নিরুদ্দেশ হয়। এখন ফেসবুকে দেখে জানলাম সে জাহাজে সাতজনকে খুন করেছে। তবে আকাশ অভাবের তাড়নায় এলাকায় মানুষের ক্ষেত, পুকুরে শাক ও মাছ চুরির অপরাধে জড়িয়েছিল। তবে কাউকে মারধর করা কিংবা আঘাত করার মতো দুঃসাহস কখনো দেখায়নি।

আকাশের বড়ভাই আবির হোসেন বলেন, আমার নানা-নানি থাকতেন সরকারি জায়গায় ঝুপড়িঘরে। তাদের মৃত্যুর পর আমিও সেখানেই থাকি। আমাদের পৈতৃক নিবাস মোল্লাহাট উপজেলার কোদালিয়া গ্রামে হলেও ছোটবেলায় বাবার মৃত্যুর পর মা ধর্মান্তরিত হয়ে অন্যত্র চলে যাওয়ায় আমরা দুই ভাই নানা-নানির কাছেই বেড়ে উঠি। আমি ফলতিতা বাজারে সিলিন্ডার গ্যাস বিক্রির একটা ছোট দোকান দিয়েছিলাম।

সেখানে কাজের সময় আকাশ একটি নারীর সঙ্গে প্রেমঘটিত ঘটনায় এলাকা ছাড়ে। এরপর আর ওই দোকান সেখানে বেশি দিন টেকেনি। গত শীতে একদিনের জন্য সে বাড়িতে আসলে তাকে বকাঝকা করে তাড়িয়ে দিই। এরপর থেকেই সে জাহাজে জাহাজে কাজ করে এবং আমার সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ নেই। তবে এলাকায় থাকাকালীন সে বিয়ে করেনি এবং মাছ ধরা ও দিনমজুরির কাজ করত।

এদিকে চিকিৎসাধীন জুয়েল নৌপুলিশকে জানিয়েছেন, এই ছেলেই ছিল সেই ঘাতক এবং সেই ছিল জাহাজের নিখোঁজ নবম ব্যক্তি।

বিষয়টি নিশ্চিত করে জেলা প্রশাসকের চার সদস্যের তদন্ত কমিটির সদস্য চাঁদপুর নৌপুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ আল মামুন। তিনি জানান, গলায় অসুস্থতায় কথা বলতে না পারলেও কাগজে ৯ জনের নাম লিখেছিলেন। সেখানে হতাহতের আটজন বাদে অন্য নামটি মূলত ইরফানই ছিল ওই ব্যক্তি যে তাকে গলায় জখম করেছিল।

তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, জাহাজটিতে কোনো সিসি ক্যামেরা ছিল না। সবাই ঘুমন্ত ছিলেন এবং ওই দিন সবাই কক্ষের দরজা খোলা রেখেছিল অর্থাৎ দরজা টানা ছিল; ছিটকানি আটকানো ছিল না। দরজা ভাঙা না থাকায় বিষয়টি সহজভাবে বুজা গেছে এবং জুয়েলের কাছ থেকে এটি নিশ্চিত হয়েছি। তবে জুয়েল ভেতর থেকে দরজা লক করায় মূলত প্রাণে বেঁচে ছিলেন। দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কাজ এগিয়ে নিচ্ছি আমরা।

চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের আরএমও ডা. আসিবুল ইসলাম আসিব বলেন, জাহাজে সাত খুনের প্রত্যেকটা মরদেহের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট আমি করেছি। প্রত্যেকেরই কানের একটু ওপরে মাথায় কোপ দিয়ে মারা হয়েছে। যে একজনকে ধরা হয়েছে, সে নেশাগ্রস্ত ছিল কিনা সন্দেহ রয়েছে। তার উগ্র আচরণের বহিঃপ্রকাশেই এমন কাণ্ড হতে পারে।

একজন সুস্থ ও স্বাভাবিক লোক কি এতগুলো মানুষকে রক্তাক্ত করে খুন করতে পারে? এ বিষয়ে চাঁদপুর মেডিকেল কলেজের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের প্রধান ডা. এএম ফরিদুজ্জামান বলেন, ইরফানের মোটিভ কী ছিলে এবং সে কি সাইকোপ্যাথ কিনা সেটি জানা এ ক্ষেত্রে জরুরি। ২৬-২৭ বয়সের যুবকরা এ ধরনের খুন করার ভালো সম্ভাবনা থাকে।

মূলত এ বয়সি যুবকদের যারা ‘এন্টি সোশ্যাল পার্সোনালিটি ডিজ-অর্ডারের মানুষ’ তারা দেশের বা সমাজের আইনকানুন মানতে চায় না। অর্থাৎ কোনো নিয়মে আবদ্ধ থাকতে চায় না। রাগ উঠলে এরা মারপিট, ভাঙচুর যে কোনো কিছু করতে পারে। পার্সোনালিটি যদি সিভিয়ার হয় সে ক্ষেত্রে এই বয়সি যুবকরা একজন সন্ত্রাসীতে পরিণত হতে পারে, কিংবা সে একজন সাইকোপ্যাথ হতে পারে।

তিনি আরো বলেন, এই বয়সটাতে এদের অপরাধবোধ কাজ করে না। এরা যে কাজ করে, সেটা কেন করে সেটাও তারা জানে না বা বুজতে চায় না। এরা খুব ছোটখাটো বিষয়েও ভাঙচুর ও মারধর পর্যন্ত করতে পারে। তার মারধরের স্বীকার লোকটি মারা গেল কিনা সেটিও তারা বুজতে চায় না বা তার বিবেককে সে নিয়ন্ত্রণ করে না।

আবার এ বয়সের ছেলেগুলো অনেক সময় তাদের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ইউরিন টেস্ট করলেই সে নেশা করত কিনা বেরিয়ে আসবে। ওই পার্সোনালিটি যুবকদের ক্রিমিনাল অ্যাক্টিভিটি থাকে। এই সমস্যা প্রবল হলে মার্ডার করাটা স্বাভাবিক। সে মূলত রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরেই এই হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটাতে পারে এবং এটা সুস্থ মস্তিষ্কে ঠাণ্ডা মাথাতেই করা সম্ভব।

এদিকে চাঁদপুর জেলা জজকোর্টের এপিপি অ্যাডভোকেট শরীফ মাহমুদ বলেন, আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থন করে আকাশ মণ্ডল ওরফে ইরফান বিচারককে বলেন, মানুষ ভুল করে। আমিও ভুল করেছি। আমাকে ক্ষমা করে দিন।

এই সাত খুনের ঘটনায় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হরিণা পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ইন্সপেক্টর মো. কালাম খান বলেন, ইরফান আমাদের কাছেই রয়েছে। সাত দিনের রিমান্ডের দুই দিনে তার থেকে অনেক তথ্যই পেয়েছি। বাকি দিনগুলোতে পূর্ণাঙ্গ তথ্য বের করব। আহত জুয়েলের সঙ্গেও আমার যোগাযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌযান পরিবহণের চাঁদপুর নৌ সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগের যুগ্ম পরিচালক শাহ মাহফুজ উল আলম মোল্লা বলেন, অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত জাহাজটিতে পাইলট ছিলেন না। এমনকি তাতে স্কট, সিসি ক্যামেরা, ভিএইচএফ যন্ত্রপাতিও ছিল না। সে ক্ষেত্রে জাহাজটি কীভাবে এতদিন নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নদীতে চলাচল করেছে? সে নিয়েও কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করছি। কেননা, অবৈধ রেজিস্ট্রেশনবিহীন কার্গো জাহাজের বিরুদ্ধে প্রায়ই আমরা জরিমানাসহ আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।

তিনি বলেন, ঘটনার খবর শুনেই ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। পরে দেখলাম জাহাজটি নোঙর করা ছিল না, বরং চরে আটকে ছিল। ওটাতে পাইলটও ছিল না। যার কারণে নির্দিষ্ট ক্যানেলের বাইরে দেখতে পাই জাহাজটি। ইরফান খালাসি পদে কাজ করতেন। মূলত খালাসিরা সাধারণত লস্করের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। তারা জাহাজের ডেকে মালামাল স্থানান্তর করত এবং ডেক বা যন্ত্রপাতি পরিষ্কার করে থাকে। কোনোভাবেই মাস্টারের ভূমিকায় জাহাজ চালানোর কথা না।

তবে দেখে দেখে হয়তো জাহাজ কিছু সময় চালাতে পারে, তবে দক্ষ চালক বা মাস্টারের মতো কখনই চালাতে পারে না। এ জন্যই হয়তো ইরফান যে সময়টুকু জাহাজটি চালিয়েছে, সেই সময়েই জাহাজটি নির্দিষ্ট ক্যানেলের বাইরে চলে যায় এবং চরে আটকা পড়ে এবং নোঙর করা ছিল না।

চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন বলেন, ৭২০  টন ইউরিয়া সার ছিল কার্গো জাহাজটিতে। তা অক্ষত হওয়ায় এবং এগুলো সরকারি সার হওয়ায় দ্রুত তা ওই জাহাজ থেকে আনলোড করে স্থানান্তরিত করতে অন্য একটি জাহাজ ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে। আইনি প্রক্রিয়া শেষে ওই জাহাজ থেকে মাল আনলোডের কাজ শুরু হবে।

তদন্ত টিমও তাদের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। এর আগে আমরা আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে লাশগুলো পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছি এবং জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতের প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকার চেক এবং নৌপুলিশের পক্ষ থেকে নগদ ১০ হাজার টাকার  দিয়েছি।

তিনি আরো বলেন, এখন পর্যন্ত চাঁদপুরের এই সাত খুনের ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণে এবং রহস্য উন্মোচনে শ্রম মন্ত্রণালয় ৫ সদস্য, জেলা প্রশাসন ৪ সদস্যের এবং জেলা পুলিশ তিন সদস্যের পৃথক তদন্ত টিম গঠন করেছে। যারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবেন।

গত ২২ ডিসেম্বর সকাল ৮টা থেকে ২৩ ডিসেম্বর দুপুর সাড়ে ১২টার মধ্যে যে কোনো সময়ে চাঁদপুরের হাইমচরের ঈশানবালাস্থ মনিপুর টেক খালপাড় সংলগ্ন এলাকায় জাহাজে সাতজন খুনের ঘটনাটি ঘটেছে বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়। এমভি আল বাখেরা কার্গো জাহাজটি ২২ ডিসেম্বর সকাল ৮টায় চট্টগ্রাম কাফকো জেটি থেকে ইউরিয়া সার বোঝাই করে চাঁদপুর মেঘনা নদী হয়ে সিরাজগঞ্জ জেলার বাঘাবাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়।

জাহাজটিতে মাস্টারসহ ৯ জন স্টাফ ছিল। ২৩ ডিসেম্বর সকালে খুনের ওই ঘটনা সামনে আসে। এতে এমডি আল বাখেরা জাহাজের মাস্টার গোলাম কিবরিয়া, গ্রিজার সজিবুল ইসলাম, লস্কর মাজেদুল ইসলাম, শেখ সবুজ, আমিনুর মুন্সী, ইঞ্জিনচালক সালাউদ্দিন ও বাবুর্চি রানা কাজী খুন হন। এ ছাড়া গুরুতর আহত হন জাহাজের সুকানি জুয়েল। তিনি বর্তমানে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নাক কান গলা বিভাগে চিকিৎসাধীন।