ময়মনসিংহ , সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ৩১ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
নোটিশ :
প্রতিটি জেলা- উপজেলায় একজন করে ভিডিও প্রতিনিধি আবশ্যক। যোগাযোগঃ- Email- matiomanuss@gmail.com. Mobile No- 017-11684104, 013-03300539.

চীন ২০টি রেল ইঞ্জিন দিচ্ছে বাংলাদেশকে বিনামূল্যে

  • ডিজিটাল রিপোর্ট
  • আপডেট সময় ১০:২৯:০৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • ২৯ বার পড়া হয়েছে

বাংলাদেশ রেলওয়ের (বিআর) জন্য ২০টি মিটারগেজ (এমজি) লোকোমোটিভ কেনায় সহায়তা হিসেবে  ১২৯ কোটি ৫৪ লাখ ডলার (প্রায় ১ হাজার ৫৯১ কোটি টাকা) অনুদান দিচ্ছে চীন। দীর্ঘদিন ধরে পুরোনো ইঞ্জিনের কারণে যে সংকট চলছে, তা নিরসনে এ উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন রেল কর্মকর্তারা।

রেল মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে ‘চায়না গ্রান্টের আওতায় বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য ২০টি মিটারগেজ ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ সংগ্রহ’ শীর্ষক প্রস্তাব অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ও পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে। ইতোমধ্যেই প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবের (পিডিপিপি) অনুমোদন প্রক্রিয়া দ্রুত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

পিডিপিপি অনুযায়ী, প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা (প্রায় ১৩৩ কোটি ১২ লাখ ডলার)। এর মধ্যে ১ হাজার ৫৯১ কোটি টাকা দেবে চীন এবং বাকি ৪৪ কোটি টাকা (প্রায় ৩ কোটি ৫৮ লাখ ডলার) আসবে সরকারি তহবিল থেকে।

প্রকল্পটি ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু হয়ে ২০২৭ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করার পরিকল্পনা আছে। এ সময়ের মধ্যে ২০টি লোকোমোটিভ সরবরাহ ছাড়াও খুচরা যন্ত্রাংশ, যন্ত্রপাতি এবং বাংলাদেশি প্রকৌশলী ও মেকানিকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও থাকবে, যাতে প্রযুক্তি ও জ্ঞানের স্থানান্তর নিশ্চিত হয়।

পিডিপিপি নথি অনুযায়ী, বর্তমানে রেলওয়ের বহরে মোট ৩০৬টি লোকোমোটিভ আছে—এর মধ্যে ১৭৪টি মিটারগেজ ও ১৩২টি ব্রডগেজ। কিন্তু এমজি লোকোমোটিভের অধিকাংশই ২০ বছরের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল অতিক্রম করেছে।

তথ্য বলছে, মোট ১২৪টি এমজি লোকোমোটিভ, অর্থাৎ বহরের ৭১ শতাংশ নকশাগত আয়ুষ্কাল পার করেছে। এর মধ্যে ৬৮টি ইঞ্জিন চলছে ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে, আর ৮৪টি ব্যবহার হচ্ছে ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে।

প্রকৌশলীদের মতে, এত পুরোনো ইঞ্জিন সচল রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। পুরোনো নকশার যন্ত্রাংশ পাওয়া যাচ্ছে না, আমদানিতে খরচ বেড়েছে, ঘন ঘন বিকল হওয়ায় রেল চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে এবং জ্বালানি খরচও বাড়ছে।

এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ‘এমন পুরোনো ইঞ্জিন রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের খরচ উৎপাদনক্ষমতার তুলনায় অস্বাভাবিকভাবে বেশি। নির্ভরযোগ্যতা এতটাই কমে গেছে যে ট্রেন বিলম্ব ও বাতিল প্রায় অনিবার্য হয়ে পড়ছে।’ তিনি সতর্ক করেন, দ্রুত নতুন লোকোমোটিভ সংগ্রহ না হলে পূর্বাঞ্চলসহ বিভিন্ন এমজি রুটে চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

লোকোমোটিভ সংকট ও বাড়তি চাহিদা
২০২০ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত ওয়ার্কিং টাইম টেবিল (ডব্লিউটিট-৫২) অনুযায়ী, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও লালমনিরহাট বিভাগে এমজি রুটে ২০৩টি লোকোমোটিভ দরকার ছিল। কিন্তু বর্তমানে সক্রিয় আছে মাত্র ১৮২টি। অর্থাৎ অন্তত ২১টির ঘাটতি রয়েছে। বাস্তবে এই ঘাটতি আরও বেশি, কারণ ২০২০ সালের পর যাত্রী ও মালবাহী পরিবহনের চাহিদা বেড়েছে।

অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে আন্তঃনগর ট্রেনকে, ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মালবাহী ও লোকাল ট্রেন। আবার সংকটের কারণে নির্ধারিত সময়ে লোকোমোটিভ ওভারহলে পাঠানো যাচ্ছে না, এতে বিকল হওয়ার প্রবণতা আরও বাড়ছে।

পরিকল্পনা ও পূর্বের ব্যর্থতা
সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় রেলওয়ের যাত্রী পরিবহন অংশীদারিত্ব ১০ শতাংশে এবং মালবাহী পরিবহন ১৫ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য রয়েছে। এজন্য রেলওয়ে মাস্টার প্ল্যানে প্রথম ধাপে (২০১৭-২০২১) ৭৪টি প্রতিস্থাপনযোগ্য ও ৩৭টি নতুন লোকোমোটিভ কেনার সুপারিশ ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেনা হয়েছে মাত্র ৩০টি।

২০১১ সালে ৭০টি এমজি লোকোমোটিভ কেনার পরিকল্পনা অর্থসংকটে বাতিল হয়ে যাওয়ায় রেলওয়েকে পুরোনো বহরের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।

নতুন লোকোমোটিভের সম্ভাবনা
রেল কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন ২০টি চীনা লোকোমোটিভ এলে যাত্রী ও মালবাহী পরিবহনে নতুন সেবা চালু করা সম্ভব হবে। রক্ষণাবেক্ষণ খরচ ও জ্বালানি ব্যয় কমবে, আধুনিক ইঞ্জিন নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য চলাচল নিশ্চিত করবে এবং আয়ও বাড়াবে।

এক কর্মকর্তা বলেন, ‘লোকোমোটিভের সংকটের কারণে রেলওয়েকে সেবা সীমিত করতে হচ্ছে এবং মেরামতের কাজ পিছিয়ে দিতে হচ্ছে। চীনের এই অনুদান কিছুটা স্বস্তি দেবে, তবে মোট চাহিদা এখনো অনেক বেশি।’

পরিবহন বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রকল্প ইতিবাচক হলেও দীর্ঘমেয়াদে মিটারগেজ ও ব্রডগেজ উভয় ধরনের লোকোমোটিভে আরও বড় বিনিয়োগ প্রয়োজন। বহরের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি এমজি ইঞ্জিন আয়ুষ্কাল পার করেছে। সময়মতো প্রতিস্থাপন না হলে শুধু কার্যকারিতা নয়, মূল রুটগুলোর সেবা ব্যাহত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। নতুন লোকোমোটিভ ছাড়া রেলওয়ে নির্ভরযোগ্য পরিবহন খাত হিসেবে যাত্রী ও মালবাহী উভয় বাজারেই বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতে পারে।

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সঞ্চয় করে রাখুন

আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

চীন ২০টি রেল ইঞ্জিন দিচ্ছে বাংলাদেশকে বিনামূল্যে

আপডেট সময় ১০:২৯:০৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশ রেলওয়ের (বিআর) জন্য ২০টি মিটারগেজ (এমজি) লোকোমোটিভ কেনায় সহায়তা হিসেবে  ১২৯ কোটি ৫৪ লাখ ডলার (প্রায় ১ হাজার ৫৯১ কোটি টাকা) অনুদান দিচ্ছে চীন। দীর্ঘদিন ধরে পুরোনো ইঞ্জিনের কারণে যে সংকট চলছে, তা নিরসনে এ উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন রেল কর্মকর্তারা।

রেল মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে ‘চায়না গ্রান্টের আওতায় বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য ২০টি মিটারগেজ ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ সংগ্রহ’ শীর্ষক প্রস্তাব অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ও পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে। ইতোমধ্যেই প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবের (পিডিপিপি) অনুমোদন প্রক্রিয়া দ্রুত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

পিডিপিপি অনুযায়ী, প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা (প্রায় ১৩৩ কোটি ১২ লাখ ডলার)। এর মধ্যে ১ হাজার ৫৯১ কোটি টাকা দেবে চীন এবং বাকি ৪৪ কোটি টাকা (প্রায় ৩ কোটি ৫৮ লাখ ডলার) আসবে সরকারি তহবিল থেকে।

প্রকল্পটি ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু হয়ে ২০২৭ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করার পরিকল্পনা আছে। এ সময়ের মধ্যে ২০টি লোকোমোটিভ সরবরাহ ছাড়াও খুচরা যন্ত্রাংশ, যন্ত্রপাতি এবং বাংলাদেশি প্রকৌশলী ও মেকানিকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও থাকবে, যাতে প্রযুক্তি ও জ্ঞানের স্থানান্তর নিশ্চিত হয়।

পিডিপিপি নথি অনুযায়ী, বর্তমানে রেলওয়ের বহরে মোট ৩০৬টি লোকোমোটিভ আছে—এর মধ্যে ১৭৪টি মিটারগেজ ও ১৩২টি ব্রডগেজ। কিন্তু এমজি লোকোমোটিভের অধিকাংশই ২০ বছরের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল অতিক্রম করেছে।

তথ্য বলছে, মোট ১২৪টি এমজি লোকোমোটিভ, অর্থাৎ বহরের ৭১ শতাংশ নকশাগত আয়ুষ্কাল পার করেছে। এর মধ্যে ৬৮টি ইঞ্জিন চলছে ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে, আর ৮৪টি ব্যবহার হচ্ছে ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে।

প্রকৌশলীদের মতে, এত পুরোনো ইঞ্জিন সচল রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। পুরোনো নকশার যন্ত্রাংশ পাওয়া যাচ্ছে না, আমদানিতে খরচ বেড়েছে, ঘন ঘন বিকল হওয়ায় রেল চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে এবং জ্বালানি খরচও বাড়ছে।

এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ‘এমন পুরোনো ইঞ্জিন রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের খরচ উৎপাদনক্ষমতার তুলনায় অস্বাভাবিকভাবে বেশি। নির্ভরযোগ্যতা এতটাই কমে গেছে যে ট্রেন বিলম্ব ও বাতিল প্রায় অনিবার্য হয়ে পড়ছে।’ তিনি সতর্ক করেন, দ্রুত নতুন লোকোমোটিভ সংগ্রহ না হলে পূর্বাঞ্চলসহ বিভিন্ন এমজি রুটে চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

লোকোমোটিভ সংকট ও বাড়তি চাহিদা
২০২০ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত ওয়ার্কিং টাইম টেবিল (ডব্লিউটিট-৫২) অনুযায়ী, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও লালমনিরহাট বিভাগে এমজি রুটে ২০৩টি লোকোমোটিভ দরকার ছিল। কিন্তু বর্তমানে সক্রিয় আছে মাত্র ১৮২টি। অর্থাৎ অন্তত ২১টির ঘাটতি রয়েছে। বাস্তবে এই ঘাটতি আরও বেশি, কারণ ২০২০ সালের পর যাত্রী ও মালবাহী পরিবহনের চাহিদা বেড়েছে।

অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে আন্তঃনগর ট্রেনকে, ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মালবাহী ও লোকাল ট্রেন। আবার সংকটের কারণে নির্ধারিত সময়ে লোকোমোটিভ ওভারহলে পাঠানো যাচ্ছে না, এতে বিকল হওয়ার প্রবণতা আরও বাড়ছে।

পরিকল্পনা ও পূর্বের ব্যর্থতা
সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় রেলওয়ের যাত্রী পরিবহন অংশীদারিত্ব ১০ শতাংশে এবং মালবাহী পরিবহন ১৫ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য রয়েছে। এজন্য রেলওয়ে মাস্টার প্ল্যানে প্রথম ধাপে (২০১৭-২০২১) ৭৪টি প্রতিস্থাপনযোগ্য ও ৩৭টি নতুন লোকোমোটিভ কেনার সুপারিশ ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেনা হয়েছে মাত্র ৩০টি।

২০১১ সালে ৭০টি এমজি লোকোমোটিভ কেনার পরিকল্পনা অর্থসংকটে বাতিল হয়ে যাওয়ায় রেলওয়েকে পুরোনো বহরের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।

নতুন লোকোমোটিভের সম্ভাবনা
রেল কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন ২০টি চীনা লোকোমোটিভ এলে যাত্রী ও মালবাহী পরিবহনে নতুন সেবা চালু করা সম্ভব হবে। রক্ষণাবেক্ষণ খরচ ও জ্বালানি ব্যয় কমবে, আধুনিক ইঞ্জিন নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য চলাচল নিশ্চিত করবে এবং আয়ও বাড়াবে।

এক কর্মকর্তা বলেন, ‘লোকোমোটিভের সংকটের কারণে রেলওয়েকে সেবা সীমিত করতে হচ্ছে এবং মেরামতের কাজ পিছিয়ে দিতে হচ্ছে। চীনের এই অনুদান কিছুটা স্বস্তি দেবে, তবে মোট চাহিদা এখনো অনেক বেশি।’

পরিবহন বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রকল্প ইতিবাচক হলেও দীর্ঘমেয়াদে মিটারগেজ ও ব্রডগেজ উভয় ধরনের লোকোমোটিভে আরও বড় বিনিয়োগ প্রয়োজন। বহরের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি এমজি ইঞ্জিন আয়ুষ্কাল পার করেছে। সময়মতো প্রতিস্থাপন না হলে শুধু কার্যকারিতা নয়, মূল রুটগুলোর সেবা ব্যাহত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। নতুন লোকোমোটিভ ছাড়া রেলওয়ে নির্ভরযোগ্য পরিবহন খাত হিসেবে যাত্রী ও মালবাহী উভয় বাজারেই বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতে পারে।