বাংলাদেশে ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইউনাইটেড স্টেটস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম’ (ইউএসসিআইআরএফ) নামের একটি ফেডারেল সংস্থা। জুলাই মাসে নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বাংলাদেশে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে তারা।
চলতি বছরের মে মাসে ঢাকায় সংস্থাটির সফরের ভিত্তিতে রিপোর্টটি তৈরি করা হয়। তখন তারা সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে। পুরো রিপোর্টটি লিখেছেন সীমা হাসান, যিনি ইউএসসিআইআরএফ-এর দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশ্লেষক।
রিপোর্টে বলা হয়, ২০২৪ সালের ৫ থেকে ৮ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগ ও সরকার পতনের সময় দেশে কার্যকর কোনো প্রশাসন না থাকায় ভয়াবহ সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে। এ সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর একাধিক হামলার খবর পাওয়া যায়, যেগুলো মূলত আওয়ামী লীগের সমর্থক বা সদস্য ভেবে প্রতিশোধমূলকভাবে চালানো হয়।
রিপোর্টে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান সংস্কারের জন্য একটি কমিশন গঠন করেছে, যার সুপারিশ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। কমিশন সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘বহুসংস্কৃতিবাদ’ বা ‘বহুত্ববাদ’ শব্দ ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছে। এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি। দলটি প্রস্তাবিত শব্দের পরিবর্তে ‘আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা’ শব্দবন্ধ অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে। অন্যদিকে ইসলামভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের গড়া জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আংশিক সমর্থন জানিয়ে ‘বহুত্ববাদ’-এর পরিবর্তে বাংলা বিকল্প ‘বহুসংস্কৃতিবাদ’ ব্যবহারের পক্ষে মত দিয়েছে।
২০২৪ সালের আগস্টে নারী সংস্কার কমিশন গঠনের পর চলতি বছরের মে মাসে কমিশনটি ৪৩৩টি সুপারিশ দেয়। এর মধ্যে একটি হলো ধর্মনিরপেক্ষ নাগরিক আইন প্রণয়নের প্রস্তাব, যা ধর্মভিত্তিক পারিবারিক আইনকে সম্পূরক করবে। এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বিক্ষোভ করেছে ইসলামপন্থি সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। তারা কমিশনকে ‘ইসলামবিরোধী’ আখ্যা দেয় এবং কমিশনের সদস্যদের নিয়ে অশালীন মন্তব্য করে। নারীদের উদ্দেশ করে কটূক্তি করার অভিযোগে ৬ নারী হেফাজতের বিরুদ্ধে আইনি নোটিশ দেন। পরে সংগঠনটি ক্ষমা চায়। এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ফেব্রুয়ারিতে একটি নারী ফুটবল ম্যাচ বাতিল করতে বাধ্য করে এবং নাদিরা ইয়াসমিন নামের এক নারী অধ্যাপককে হুমকির মুখে কলেজ বদল করতে হয়।
যুক্তরাষ্ট্র সরকার পরিচালিত এই সংস্থার রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে এখনো ব্লাসফেমি সংক্রান্ত ধারা (দণ্ডবিধি ১৯৫এ) বলবৎ রয়েছে, যেখানে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করাকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। ২০২৩ সালের সাইবার সিকিউরিটি আইন অনুযায়ী, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে এমন ডিজিটাল কনটেন্ট প্রকাশ করলে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। এসব বিষয় নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউএসসিআইআরএফ।
সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং ধর্মীয় সহনশীলতার ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগ রয়েছে। সংবিধান সংস্কারে সংখ্যালঘুদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত না হলে, এই প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদে বৈষম্য আরও গভীর করতে পারে। ইউএসসিআইআরএফ-এর মতে, বাংলাদেশে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহনশীলতা রক্ষায় একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। সংবিধান সংস্কারের এই পর্যায়ে রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাই দীর্ঘস্থায়ী শান্তির মূল চাবিকাঠি হতে পারে।